পুলিশ কি আপনাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারে?
এক কথায় উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, পারে। এখন মনে প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক, কোন আইন বলে পুলিশ এটা করে বা করতে পারে?
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৪ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে পুলিশ যে কাউকে বিনা পরোয়ানায় অর্থাৎ আদালতের আদেশ ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে।
তাই বলে পুলিশ যে কাউকে যখন তখন বিনা কারণে আদালতের আদেশ ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারে না। কারণ যে আইনে তাকে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দিয়েছে সেই আইনেই বলে দেয়া আছে কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ কিভাবে গ্রেপ্তার করতে পারবে।
যেসব ক্ষেত্রে পুলিশ আদালতের নির্দেশ ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারে:
যিনি আমলযোগ্য অপরাধের সাথে জড়িত বা যার বিরুদ্ধে ওই ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত থাকার যৌক্তিক অভিযোগ রয়েছে বা জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে বা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ রয়েছে; আইন সঙ্গত কারণ ছাড়াই যিনি ঘর ভাঙার সরঞ্জাম দখলে রাখেন; এই আইনানুযায়ী যিনি অপরাধী বা সরকার যাকে অপরাধী ঘোষণা করেছে; যার দখলে চোরাই মাল রয়েছে এবং এইরূপ পণ্যের সাথে যার অপরাধ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে; যিনি পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দিয়েছেন বা পুলিশ হেফাজত থেকে পলায়ন করেছেন বা পালানোর চেষ্টা করেছেন; যিনি সশস্ত্র বাহিনী থেকে পালিয়ে এসেছেন; যিনি বাংলাদেশের বাইরে এমন কোনো অপরাধ করে দেশে চলে এসেছেন, যা দেশে করলে তিনি অপরাধী হিসেবে শাস্তি পেতেন অথবা দেশের বাইরে এরূপ কোনো অপরাধের সাথে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট তথ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বা যুক্তিসঙ্গতভাবে সন্দেহ করা যাচ্ছে; দণ্ডভোগের পর মুক্ত ব্যক্তি যদি অজ্ঞাত স্থানে (সন্দেহ জনকভাবে) বসবাস করেন; কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধের জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করতে অপর কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে সুস্পষ্ট অনুরোধ পেলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে।
তবে এই ধারায় গ্রেপ্তারকৃতকে পুলিশ অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করবেন। এর অন্যথা করার কোনো সুযোগ আইন পুলিশকে দেয়নি।
উপরোক্ত বিধান পড়লে মনে হতে পারে যে, আইন কি তবে পুলিশকে স্বেচ্ছাচারী করলো? আসলে তা নয়। খুব ক্ষুদ্র পরিসরে চিন্তা করলে এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই আইনটির প্রণেতাদের উদ্দেশ্য ছিল আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া। ক্রমবর্ধমান অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের শাস্তি বিধানের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নিরীখে পুলিশকে ব্যাপক ক্ষমতায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এই ধারায় বর্ণিত পুলিশের ক্ষমতার সীমারেখা হচ্ছে যুক্তিসঙ্গত ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রয়োজনীয় শর্ত। আইনের এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘গ্রেপ্তার করতে পারেন (May arrest)’ অর্থাৎ গ্রেপ্তার করার এই ক্ষমতা বিবেচনা প্রসূত। এই ধারায় আরো বলা হয়েছে, ‘যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ’, এর অর্থ হচ্ছে- অপরাধটি এই ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বা অপরাধটি সংঘটিত হতে যাচ্ছে।
আইনের এই ধারায় যাই বলা থাকুক না কেন, এর অপব্যবহার যে হচ্ছে না তা কিন্তু বলা যাবে না। কোনো কোনো পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবেই এই ধারার অপপ্রয়োগ করছেন আবার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে (সরল বিশ্বাসে) অপপ্রযোগ হয়ে যাচ্ছে। এসব অপপ্রযোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি মনিটরিং করে থাকেন। আবার ভূক্তভোগী ইচ্ছে করলে আদালতের মাধ্যমে প্রতিকারও পেতে পারেন।
এই ধারার বিধানের অপপ্রয়োগ বিষয়ে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের কিছু নজির রয়েছে, যা আইনটির প্রযোজ্য ব্যক্তি ও প্রয়োগকারীদের জন্য অবশ্য প্রতিপালনীয় সুস্পষ্ট বার্তা। যেমন-
নজির-১: ‘কোনো আমলযোগ্য অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকলে পুলিশ এই ধারার বিধান বলে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবে। [29 DLR 256 (SC) at 258 Abdur Rahman vs. The State]’
নজির-২: ‘যেহেতু আটককৃত ব্যক্তিকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেহেতু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করার দায়িত্ব ছিল পুলিশের, কিন্তু পুলিশ উহা না করায় বন্দীর সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। [52 DLR (HC) 526- Mehnaz Sakib Vs. Bangladesh]’
চূড়ান্তভাবে বলা যায়, অপরাধমুক্ত একটি বাসযোগ্য সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য দল-মত নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারে তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করা। এর ফলে আইনটির অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা ও হার সহনীয় মাত্রায় নেমে আসবে।
লেখক:
অ্যাডভোকেট প্রিয়লাল সাহা
[email protected]
মন্তব্য চালু নেই