পিয়াস করিমের ভার বইবে না শহীদ মিনার!

১৪ অক্টোবর ২০১৪। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতে থাকি। হঠাৎ একটা নিউজ চোখে পড়ে জনপ্রিয় টকশো আলোচক ড. পিয়াস করিম আর  নেই। আর কোনো নিউজ পড়তে ভাল লাগল না। পত্রিকা পড়া বন্ধ করে দিলাম। পুরো শরীরটা অবশ হয়ে গেল। বিশ্বাস করতে পারছি না যে, ড. পিয়াস করিম স্যার আমাদের মাঝে আর নেই। খুব কষ্ট পেলাম। এই দুর্দিনে স্যারের বিদায় সত্যিই বড় বেদনার। বড় ক্ষতি হয়ে গেল এ জাতির। সত্য ও স্পষ্টবাদী একজন মানুষকে হারাল এ মজলুম জনপদের মানুষ। মৃত্যু সংবাদ শোনা মাত্রই স্যারের কয়েকজন মিডিয়া কর্মীর কাছে ফোন দিলাম। বিষয়টি নিশ্চিত হলাম। ফোন দিয়েছিলাম রাবি লেখক ফোরামের সভাপতি ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দের কাছে। সালাম বিনিময়ের পর বললাম স্যার কেমন আছেন? জবাবে বললেন ভাল নেই। কোনো খবর জানো কি? ড. পিয়াস করিম স্যার আর নেই। বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেললেন। এ রকম বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোক নেমে আসে। সত্যি স্যারের অকাল মৃত্যু আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশেষ করে সমকালীন তরুন প্রজন্ম তার আলোচনার মাঝে থাকত। তার মৃত্যু যেন কেউ মেনে নিতে পারছে না। যা হোক প্রত্যেক প্রাণিকে অবশ্যই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। কাউকে জোর করে আমরা আটকে রাখতে পারব না। উল্লেখ্য, ড. পিয়াস করিম এর মৃত্যুতে আবার অনেক উল্লাসিতও হয়েছে। কারণ স্যার যে হক কথাগুলো জাতির সামনে তুলে ধরতেন। এমন কি বহুবার তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে।  নানা ভাবে হররানির সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। তার মৃত্যুর পরও সেই ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই; সে দেশে গুণী জন্মায় না। ড. পিয়াস করিম বরাবরই এদেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণে কথা বলেছেন। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কথা বলেছেন। তিনি কখনো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেননি। বরাং প্রকৃত দোষীদের শাস্তির দাবী তুলেছেন উদ্বেলিত কণ্ঠে। অথচ তাকে মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাতারে ঠেলে দিয়েছেন একটি মহল। তারা নিজেরা স্বাধীনতার রক্ষক বনে গিয়ে ড. পিয়াস করিমের মতো বুদ্ধিজীবীকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। আজ জানতে বড় ইচ্ছা করে স্বাধীনতা ও শহীদ মিনার শুধু কি একটা গোষ্ঠীর? নাকি গোটা জাতির? এটা কি কারও পৌত্তিক সম্পক্তি? যে এখানে অন্য কেউ যেতে পারবে না। কারা পিয়াস করিম স্যারকে শহীদ মিনারে নিতে দিল না। তাদের পরিচয়টা বলা দরকার। তাদের পরিচয় ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজি, ইভটিজার, খুনি সহ নানা কুকর্মের হোতা। আজ তারা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শেখাতে চায়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শেখাতে চায়। যদি সাহস থাকে তাহলে জাতির সামনে বলুন, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবে না। করো আজ বুঝতে বাকি নেই ড. পিয়াস করিম স্যার যদি আওয়ামী লীগের মিথ্যা সাফাই গাইত তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথা হতো। কিন্তু সেটি তিনি করেন নি। তাই আজ তাকে রাজাকার হতে হলো। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঘোষণা শুনে অবাক হওয়ার মতো। ড. পিয়াস করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সাবেক একজন ছাত্র হিসেবে তার লাশ শহীদ মিনারে নেওয়াটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গৌরবের বিষয়। কিন্তু আমরা দেখলাম তার উল্টোটা। এমন বড় মাপের একজন বুদ্ধিজীবীর স্থান হলো না শহীদ মিনারে। ধীক! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ীদের। শহীদ মিনারের কথা উঠল যখন না বলেই পারলাম না। সেই ছেলেবেলার কথা ২৬ মার্চ, কিংবা ২১ শে ফেব্রুয়ারীতে সব বন্ধুরা মিলে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যেতাম। কেউ তো আমাদেরকে ঠেলে দিতো না।  কিংবা নিষেধ ছিল না। ভাবতাম শহীদ মিনার সবার জন্য। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অধিকার সবার রয়েছে। কিন্তু আজ কী দেখতে হচ্ছে- শহীদ মিনার মানে আওয়ামী লীগ। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। এদিকে image_102413শহীদ মিনার এলাকায় সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার, মানব জমিন সম্পাদক ও জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউ এজ সম্পাদক ও টক শো আলোচক নূরুল কবির। সাপ্তাহিক এর সম্পাদক গোলাম মোর্তজা, আইনজীবী ড. তুহিন মালিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিক নজরুল, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। লজ্জাই মাথা হেঁট হয়ে যায় আর এটি ঘোষণা দেয় সিপি গ্যাং নামের একটি সংগঠন। যারা শহীদ মিনারে উল্লেখিত বুদ্ধিজীবী ও ড. পিয়াস করিম স্যারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। কী তাদের পরিচয়? সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত স্থাপন ইতিহাস কখনো ক্ষমা করবে না। এভাবে আর কতদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফেরিওয়ালাদের দাম্ভিকতা দেখতে হবে। জানি না তবে এতটুকু বলে রাখি- ইতিহাস বিকৃতির খেসারত একদিন দেওয়া লাগবেই। মুক্তিযুদ্ধ আর তরুন প্রজন্মের দোহাই সেদিন কাজে লাগবে না। সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি হচ্ছে মিথ্যার সব প্রাসাদ ভেঙে দিয়ে সঠিক ইতিহাস বির্নিমানে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তমাচ্ছন্ন এ জাতির কান্ডারী হবে। আশা করি সেদিন প্রকৃতগুণীরা কদর পাবে। মুক্তিযুদ্ধের বিভাজন দূর হবে। আর ড. পিয়াস করিম স্যারকে বলব, প্লিজ ক্ষমা করবেন। আমরা সত্যিই লজ্জিত ও দুঃখিত। হয়তো শহীদ মিনারে আপনাকে ঠাঁই হয়নি কিন্তু আপনার ঠাঁই কোটি কোটি ভক্ত অনুরাগী ও বিশ্বাসী মানুষের হৃদয় মিনারে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।



মন্তব্য চালু নেই