পিরিয়ড হওয়ায় একঘরে, কিশোরীর মৃত্যু

“ওই মেয়ে তোর কীসের আবার ব্যথা/ওই মেয়ে তোর মুখটা কেন খোলা/ জানিস না তুই শুধু মেয়ে তাই/ যন্ত্রণাতেও যায় না কথা বলা !”- মেয়েদের ওপর অত্যাচার কবে শেষ হবে জানা নেই। রাজপথ থেকে মেঠোআল, আজও মেয়েদের উপর নির্যাতন হয়েই চলে।

প্রতিবাদ করলে প্রকাশ্য রাস্তায় মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়, রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বেইজ্জত করা হয় বছর ষোলোর কিশোরীকে, মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে নষ্ট করে দেওয়া জীবন-বুঝিয়ে দেওয়া হয় তুমি মেয়ে তাই…! এ অত্যাচারের শেষ কোথায় ? প্রশ্নটা উত্তর খুঁজে মাথা খুঁড়ে মরে আজও। উত্তর তো মেলেই না উপরন্তু আবার ঘটে যায় একটা নির্যাতন। আবারও অত্যাচারিত হয় একটা মেয়ে। এই এবার যেমন নেপালে একটা মেয়ে মরেই গেল। বেঘোরে। তার ‘অপরাধ’ ? পিরিয়ডস হয়েছিল।
আশ্চর্য হওয়ারই কথা। ঋতুমতী হওয়া তো অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। তাহলে কেন এমনটা হলো? সেই ঘটনাটাই এবার বলা যাক। ঘটনা নেপালের আছাম জেলার। গজরা গ্রাম। কাঠমাণ্ডু থেকে ৪৪০ কিলোমিটার দূরে। সেই গ্রামেই থাকত বছর পনেরোর একটা মেয়ে। হাসিখুশি। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকা গ্রামটিতে আর সব থাকলেও শিক্ষার আলোর বোধহয় বড়ই অভাব। নাহলে কেনই বা পিরিয়ডস হওয়া মেয়েদের সবার থেকে আলাদা- প্রায় একঘরে করে রাখা হবে সেখানে ? কেনই বা সদ্য মা হওয়া মেয়েদের ধরে নেওয়া হবে অপবিত্র বলে? যাইহোক, এই গ্রামে এখনও চালু আছে ভয়ানক এই কুসংস্কার। পোশাকি নাম-ছৌপড়ি। তুমি ঋতুমতি হয়েছ, অতএব তুমি পবিত্র নও। তোমাকে থাকতে হবে সবার থেকে আলাদা-একা। গ্রামবাসীরা মনে করে, ঋতুমতী মেয়ে একসঙ্গে থাকলে তা দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে সমাজে। আসতে পারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। অতএব-একলা থাকো মেয়ে।

বছর ১৫-র মেয়েটিও একদিন বুঝতে পারে তার শরীরের পরিবর্তন। জানতে পারে পাড়া-পড়শিও। রায় দেয় মাতব্বররা। একলা থাকো। মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের এককোণে। কুঁড়েঘরে। বেশিরভাগ সময় সেই কুঁড়েঘরে গরু-ছাগলের সঙ্গে ঋতুমতীদের কাটাতে হয় একসঙ্গে। এই কটাদিন। দেওয়া হয় না স্বাভাবিক খাবার। পানি।

রোদে পুড়ে, পানিতে ভিজে কোনওমতে দিন কাটাতে হয় মেয়েদের। আরও নানা বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। কার সঙ্গে দেখা করা যাবে, কোথায় যাওয়া যাবে-নিয়ম চাপানো হয় সবকিছুর উপরই। তেমনটা হয়েছিল বছর পনেরোর ওই কিশোরীর সঙ্গেও।

তারপর গত সপ্তাহে কোনও একদিন। ডিসেম্বরের সতেরো বা আঠেরো হবে। ধুলোয়-কাদায় মাখামাখি হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল মেয়েটি। চোখ ছিল খোলা। যেন মূক ও বধির সমাজের কাছে হাজার প্রশ্ন করতে চাইছিল নিথর চোখদুটো। কেন মরে যেতে হল আমায়? কেন মরতে দিলে আমাকে? মেয়েটা মৃত্যুর আগে এই প্রশ্নগুলো করতে চেয়েছিল কি না জানা যায়নি।

মেয়েটির বাবা প্রথমে দেখেন মেয়ের নিথর দেহটা। ছুটে যান। কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। কীই বা আর করার ছিল !

পুলিশ আসে। লাশ নিয়ে চলে যায়। পরে জানায়, সম্ভবত শীতে কুঁকড়ে থাকা শরীরে একটু উষ্ণতা চেয়েছিল মেয়েটা। বদ্ধ কুঁড়ের মধ্যে জ্বালিয়েছিল আগুন। তারপরই ঘুমোতে গিয়েছিল। বদ্ধ ঘরে অক্সিজেন ঢুকতে পারেনি। দমবন্ধ হয়ে মারা যায় মেয়েটা।

তবে এই প্রথম নয়। এই প্রথার জেরে গত ১৯ নভেম্বর মৃত্যু হয়েছিল আরেক নারীর। সেই খবরে নাকি নড়চড়ে বসেছিলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রীও। ২০০৭ সাল থেকে আছাম জেলায় একই ইস্যুতে মৃতের সংখ্যা অন্তত ৮।

প্রশাসন এই প্রথা নিষিদ্ধ করে অনেক আগেই। ২০০৫ সালে নেপালের সর্বোচ্চ আদালত ছৌপড়িকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু, আদালত নিষিদ্ধ করলে কী হবে- যা মানুষের মজ্জায় মজ্জায়ে গেঁথে গেছে, তাকে অত সহজে উপড়ে ফেলা কী সম্ভব ? ২০১১ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, আছাম জেলায় কমপক্ষে ৯৫ শতাংশ নারী ছৌপড়ি প্রথা পালন করে। সরকার সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রচার অভিযানও চালায়। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয় না।

তাহলে এর থেকে বাঁচার উপায় ? ঘরের মেয়ের অকাল মৃত্যু চোখ খুলে দেবে মানুষের। বন্ধ হবে মেয়েদের উপর এই অত্যাচার-কুসংস্কার। আশায় বসে প্রশাসন।



মন্তব্য চালু নেই