পাঁচ দিন ধরে লাশের অপেক্ষায় পারভীনরা

টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলস কারখানা চত্বরে এখনো বিলাপ করে চলছেন পারভীন, তানিয়া ও হারুনরা। এদের মধ্যে ১১ বছরের সংসার জীবনে নিঃসন্তান পারভীন বিলাপ করে বলছেন, ‘এই দুনিয়ায় স্বামী ছাড়া আমার আপন কেউ নাই। সংসারে কোন পোলা-মাইয়ার মুখ দেখতে পারিনাই। একমাত্র সম্বল স্বামীটারেও নিয়া গেল আগুনে। জীবিত না পাইলেও মৃত স্বামীর লাশটা চাই আমি। আমারে আমার স্বামীর লাশটা ভিক্ষা দেন।’

পারভীনের মতো আরও অনেকেই বিলাপ করে চলছেন। তবে পারভীনের আকুতি সেখানকার অনেক মানুষকেই বিচলতি করে তুলছে। টাম্পাকো ট্রাজেডির খবর শোনার পরই পারভীন ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। গত পাঁচ দিন ধরে টানা বিলাপ করে চলছেন।

১১ বছর আগে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। দীর্ঘ এক দশকের বেশি বিবাহিত জীবনে কোনো সন্তান না আসলেও তাদের ভালোবাসার কোনো ঘাটতি পরেনি। স্বামী আজিম উদ্দিন কারখানার কাজে যোগদেয়ার আগে পারভীনের সঙ্গে ঈদ নিয়েও কথা হয়। আজিম স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘ঈদের সময় তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবো। নতুন শাড়ি কিনে দেব।’

কান্নাজড়িত কন্ঠে পারভীন অনবরত বলে যাচ্ছিলেন, ‘ঈদে এবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল না। শনিবার সকালে কারখানায় যাওয়ার সময় স্বামী আমারে কইয়া গেছে তোমারে ঈদের দিন ঘুরতে লইয়া যামু। একখান শাড়ি কিনা দিমু। সেই শাড়িও কেনা হলো না আমার, স্বামীর সাথে ঘোরাও হলো না।’

অগ্নিকান্ডে ধ্বংসস্তূপে পরিণত টাম্পাকোর সামনে বাবা আবু তাহেরকে সঙ্গে নিয়ে ভাইয়ের লাশের অপেক্ষায় ৫দিন ধরে অপেক্ষায় তানিয়া। এই কারখানায় মেশিন হেলপার হিসেবে কাজ করত তার ভাই রিয়াদ হোসেন মুরাদ।

তানিয়া বলেন, ‘শুক্রবার রাতের পালায় কাজ করার জন্য মুরাদ রাত ১০টার দিকে কারখানায় যায়। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বাবার সাথে শেষবারের মতো কথা হয় মুরাদের। আগুন লাগার সংবাদ শুনে মুরাদের মোবাইলে কথা বলার অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু মোবাইল অফ পাইতেছি।

এরপর টঙ্গী মেডিকেল, কুর্মিটোলা মেডিকেল, ঢাকা মেডিকেলসহ অনেক হাসপাতালে ভাইকে খুঁজছি। কোথাও ভাইকে খুঁইজা পাইনাই।’

তানিয়া বলেন, ‘শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) থেকে ভাইয়ের জন্য কারখানার সামনে বইসা রইছি। আমার ভাইকে জীবিত পাওয়ার আশা ছাইড়া দিছি আমরা। এখন ভাইয়ের লাশটা আমাদের বের কইরা দেন। লাশটা পাইলেও বাবারে সান্তনা দিতে পারমু।’

মুরাদ সপরিবারে টঙ্গীর পূর্ব আরিচপুরে ভাড়া থাকতো। তাঁর গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুরের রামগতিতে।
কারখানার ষ্টেডিং মেশিন অপারেটর হিসাবে কাজ করতো আনিসুর রহমান। শনিবার সকালের পালায় কাজ করতে ভোর সাড়ে ৫টায় বাসা থেকে বের হন তিনি। বিস্ফোরণের পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন আনিসুর।

আনিসুরের ভাই হারুন-অর-রশিদ গাজী ভাইয়ের জন্য কারখানার সামনে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। তিনি জানান, নতুন করে লাশ উদ্ধারের খবর পেলেই ছুটে যাই লাশ দেখতে। এই বুঝি আদরের ভাইটির লাশ উদ্ধার হলো। ভাইয়ের লাশটি ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে টাম্পাকোর সামনে বিলাপ করছেন হারুন।
উল্লেখ্য, গত শনিবার ভোর পৌনে ৬টার দিকে টঙ্গীর বিসিক এলাকার প্যাকেজিং কারখানা টাম্পাকো ফয়েলস-এ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে বয়লার বিস্ফোরণের কারণে আগুন লেগেছে বললেও পরবর্তীতে কারখানার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা দাবি করেন গ্যাস লাইনে লিকেজের ফলে আগুনের সূত্রপাত। অগ্নিকান্ডে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট কাজ করেছে। ইতোমধ্যে উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল। সেনাবাহিনীকে উদ্ধারকাজে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ স্বেচ্ছাসেবীরা। অগ্নিকান্ডে এ পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই