পরদিনই ইতালি ফেরার কথা ছিল গুলশানে নিহত অন্তঃসত্ত্বা মন্টির

আইরিন পারভিন খান, ইতালি থেকে : সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। ৩৩ বছর বয়সী সিমনা মন্টি কয়েক মাস আগেই জানতে পেরেছিলেন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। ঠিক করেছিলেন সন্তানের জন্ম দেয়ার জন্য ফিরে যাবেন জন্মভূমি ইতালিতে। পরের দিনই তার ফেরার কথা ছিল ।

তার ফিরে যাওয়াকে উদ্দেশ্য করে গুলশানে হলি আর্টিজানে একত্রিত হয়েছিলেন বন্ধুরা। কিন্তু অভিশপ্ত সে রাতে সন্ত্রাসীরা বাঁচতে দেয়নি তাকে। গুলশান হামলায় প্রাণ হারান এ নারী। তার আর ফেরা হয়নি নিজ দেশে। ফিরেছে তার লাশ। সিমনের ভাই জানান, খুব প্রাণবন্ত ছিল তার বোন।

হলি আর্টিজানে সেই ভয়ঙ্কর রাতে এমন প্রাণ হারিয়েছেন ২০ জন। তাদের ৯ জনই ইতালির। নিজ দেশে এরইমধ্যে ফিরে গেছে তাদের মরদেহ। ইতালির প্রেসিডেন্ট সেরজো মাত্তারেলা শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন মরদেহের প্রতি। শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দেশটির সর্বস্তরের জনগণ। গুলশান হামলার রাতে হলি আর্টিজানে ছিলেন ১১ ইতালীয়। তাদের মধ্যে তিনজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিহতদের মধ্যে আরেকজন নাদিয়া বেনেদেত্তি, বয়স ৫২, ভিতেরবো শহরের বাসিন্দা। গত বিশ বছর যাবৎ তিনি ঢাকায় কর্মরত ছিলেন।

নিজের জীবনের সবটুকু সময় তিনি কাজের মধ্যই কাটিয়েছেন। তার ভাগ্নি জুলিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেন, একদল জানোয়ার তাকে নিয়ে গেল। ৫৪ বছর বয়সী আদেলে পুলেজে কোয়ালিটি কন্ট্রোলার ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন আর্টসানা বাইং হাউজে। আদেলে অবিবাহিত ছিলেন। কাতানিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা আদেলের দেশে ফেরার কথা ছিল কয়েক দিনের মধ্যে। ক্লাউডিয়া মারিয়া ডা আন্তনা। তুরিনের বাসিন্দা। ৫৬ বছর বয়সি ক্লাউডিয়া অনেক বছর ধরে পূর্বের দেশসমূহে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতেন।

সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশে বসবাস ছিল তার। ক্লাউডিয়ার স্বামী জান্নি গালেজ্জ বাস্কেত্তি ফেড ট্রেডিং নামের একটি বায়িং হাউজের স্বত্বাধিকারী। গালেজ্জে বাস্কেত্তি ফোন করবার জন্য রেস্তোরাঁর বাগানে গেলে জঙ্গি হামলা শুরু হয়। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পালিয়ে যান জান্নি। সর্বশেষ, ক্লাউডিয়া স্বামীর নাম ধরে আর্তচিৎকার করছিল জানায় জান্নি গালেজ্জ বাস্কেত্তি। ক্লাউডিয়ার বোন ফাব্রিজযিয়া ডি আন্তনা, জানান জীবনের অর্ধেক সময় সে ভারত বাংলাদেশে কাটিয়েছে। কখনও কোনো প্রকার ভয় বা আতঙ্কের কথা বলেনি। তারা নিজেদের প্রাইভেটকারেই চলাফেরা করতো।

ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব বা পরিচিত বন্ধুদের বাসায় আড্ডাতে যেত এই রেস্টুরেন্টটিতে তারা নিয়মিত আসতো। সুখী দম্পতি ছিল ক্লাউডিয়া ও জান্নি। মারিয়া রিবলি। ৩৪ বছর বয়সী মারিয়ার বিয়ের পর আবাস হয়, বেরগামাস্কার দ্বিপঅঞ্চল সলজায়। মারিয়া তিন বছর বয়সি মেয়েকে রেখে কাজের সন্ধানে বের হয়। ঢাকায় একটি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো সে। আরেক নিহতের নাম- মার্ক টোনডাট। ৩৯ বছর বয়সী মার্ক পরদননের বাসিন্দা। বছর খানেক আগে কাজের সন্ধানে দেশ ছাড়ে মার্ক। বিবাহিত মার্কের পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে।

মার্কের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার ভাই জানান, সাহসি অ্যাডভ্যাঞ্চার প্রিয় ছিল সে। অর্থনৈতিক মন্দায় কাজের বাজার ভালো নেই। চাকরির সন্ধানে ঢাকা যায় সে। ঢাকা সম্পর্কে কখনও কোনো খারাপ মন্তব্য করেনি মার্ক, পরিবারকে সব সময় নিজের ভালো লাগার কথা জানিয়েছে। ক্রিস্টিয়ান রোসি। উদিনে তার বাসা। তিন বছর বয়সী দুই যমজ সন্তানের পিতা ক্রিস্টিয়ান দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশের সঙ্গে পোশাকশিল্প ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। ক্লাউডিও কাপেল্লি ৪৫ বছর বয়স। লোমবারডিয়ার বাসিন্দা ক্লাউডিওর স্ত্রী ও ছয় বছরের সন্তান আছে। বিগত পাঁচ বছর যাবৎ তিনি ঢাকায় ছিলেন। তার নিজস্ব পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। ভিনচেঞ্জজ দালে কাম্পানের বাসিন্দা ছিলেন। জন্ম সুইজারল্যান্ডে। তার পরিবার নেপোলিতে থাকলেও কাজের জন্য প্রায় সারা বছর দেশের বাইরে থাকতেন দালেস্ত্র। পোশাক শিল্প সেক্টরে কাজ করতেন। দালেস্ত্রর স্ত্রী একই প্রতিষ্ঠানের ফ্যাশন ডিজাইনার।

পালিয়ে আত্মরক্ষা করা দুজন ইতালিয়ানের মধ্যে ক্লাউডিয়া মারিয়া ডা আন্তনার স্বামী জান্নি গালেজ্জ বাস্কেত্তি। জান্নি ফোন রিসিভ করতে বাগানে বের হলেই, সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়, গাছের ঝোঁপের আড়াল হতে দেখতে পায়, তাৎক্ষণিক বুঝতে পারে আত্মরক্ষাতে পালাতে সক্ষম হয়। জান্নি নিজস্ব দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ঢাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলেন, গত দুই বছর যাবৎ ঢাকার পরিস্থিতি ভালো নয়। ইতিপূর্বে ইতালিয়ান নাগরিক হত্যা হয়েছে। জান্নি ও ক্লাউডিয়া বন্ধু মহলের মধ্যেই চলাফেরা করতেন। আত্মরক্ষাকারী আরেকজন ইতালিয়ান হলেন, ৩৪ বছর বয়সী জাকপো বিওনি। জাকপো স্প্যানিশ রেস্টুরেন্টটিতে সেফ ছিলেন।

তিনি জানান, আর্জেন্টিনার মূল সেফ না থাকায় সেই রাতে তার ডাক পড়ে। সাধারণত সে ডেজার্ট, ইতালিয়ান চিজ বানাতো। জঙ্গি হামলার পর কিচেন হতে উকি দিয়ে দেখতে পায়, ইতালিয়ান নাগরিকদের টেবিলে ধারালো অস্ত্র সঙ্গে সন্ত্রাসীদের দেখে। ভয়ে লুকিয়ে যায় জাকপো। কিচেনের অন্য বাবুর্চিরা তাকে লুকাতে সহায়তা করে। সন্ত্রাসীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে, দোতলার ছাদে উঠে সে। সেখান হতে জীবনের রিস্ক নিয়ে লাফ দেয় দেয়ালের ওপারে। হাতে পায়ে ব্যথা পেলেও বুঝতে পারে, আর কোনো উপায় নেই, সন্ত্রাসীদের টার্গেট সাদা চামড়ার লোক। পালানো ছাড়া আর কোনো চিন্তা আসেনি তার। দেয়াল টপকে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত আত্মোগোপন করে থেকে নিজ বাসায় গিয়ে, পাসপোর্ট নিয়েই এয়ারপোর্ট আসে। প্রথম ফ্লাইটটি ছিল ব্যাংককের। কালবিলম্ব না করেই, ঢাকা ছাড়েন জাকপো।

ওদিকে, নিহত ৯ জন ইতালিয়ান নাগরিকের মরদেহ সোমবার রোমের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর চাম্পিনতে এসে পৌঁছায়। দুর্ঘটনার পর রোম হতে পাঠানো সামরিক বিমান বোয়িংকে সি ৭৬৭ এ করে লাশবাহী কফিনগুলো নিয়ে আসা হয়। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ রোমে এসে পৌঁছায় বিমানটি। এয়ার পোর্টের বাতাস ভারী হয়ে উঠে শোকে। দেশটির সরকার প্রধান সেরজো মাত্তারেলা দক্ষিণ আমেরিকায় তার রাষ্ট্রীয় সফর স্থগিত করে ফিরে আসেন। -মানবজমিন



মন্তব্য চালু নেই