পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর রেলপথ হবে
পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। মূল পদ্মা সেতু ও নদীশাসনের কাজ পেয়েছে চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান। রেলপথ নির্মাণের কাজও করবে চীন সরকার মনোনীত প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড। মূল সেতুতে রেল সংযোগসহ একদিকে ঢাকা ও অন্যদিকে যশোর পর্যন্ত এই রেলপথ হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মাণ করা হবে রেলপথ। প্রকল্পে ব্যয় হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। মূল পদ্মা সেতুতে বর্তমানে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সেতু বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
রেলপথ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল গত ২৪ জানুয়ারি। এরপর চায়না রেলওয়ে গ্রুপ বাংলাদেশের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে সম্প্রতি
প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রথম দিকে পদ্মার ওপর প্রস্তাবিত সেতুতে শুধু সড়ক সেতুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু সরকার পরে ২০১১ সালে প্রকল্পে সড়ক সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ রেখে প্রস্তাব সংশোধন করে।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার অর্থায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তার পর বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ‘না’ বলে দেয়। অন্য সংস্থাগুলোও মুখ ফিরিয়ে নেয়। পদ্মার ওপর মূল সড়ক সেতুর কাজ তাই দেশীয় অর্থায়নে শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগসহ ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য রেলওয়েতে ১১ সদস্যের মূল কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কারিগরি উপকমিটিও গঠন করা হয়েছে। কারিগরি উপকমিটি মূল কমিটির কাছে তাদের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। মূল কমিটির অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালক (সংগ্রহ) মাসুদ আল ফাত্তাহ এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, প্রথমে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ দশমিক ৩২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছিল। তাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। পরে বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে আলোচনার পর অর্থায়নের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ায় এখন রেলপথ নির্মাণ করা হবে ১৬৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত নির্মিতব্য রেলপথের ২১ কিলোমিটার অংশ হবে উড়াল রেলপথ। এই অংশের মধ্যে আবার তিন কিলোমিটার হবে ডাবল লাইন ডুয়েল গেজ। প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। দ্রুতই প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প ছক (ডিপিপি) তৈরি করা হবে।
এ ব্যাপারে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, এই প্রকল্পে অগ্রগতি হচ্ছে। প্রস্তাব পর্যালোচনা চলছে।
জানা গেছে, প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও সাইট নির্ধারণ করা হয়ে গেছে। রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হকসহ অন্য কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরুর স্থান রাজধানীর গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশন পরিদর্শন করেছেন।
প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরির সঙ্গে যুক্ত রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে রেলপথটি গেণ্ডারিয়া পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে এটি বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী-১, ধলেশ্বরী-২, মূল ধলেশ্বরী—এই চার নদীর ওপর দিয়ে মাওয়ায় যাবে। মাওয়ায় উড়াল পথ হয়ে রেলপথটি সড়ক সেতুর নিচ দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে যাবে যশোরের সিঙ্গিয়া পর্যন্ত। এই রেলপথে ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার মানুষ রেল সেবার আওতায় আসবে।
প্রকল্পের আওতায় চারটি বড় ও ৫৬টি ছোট রেলসেতু, পাঁচটি লেভেলক্রসিং, ৪০টি স্থানে আন্ডারপাসসহ জাতীয় মহাসড়কে তিনটি উড়াল সড়ক নির্মাণের দরকার হবে। জানা গেছে, ঢাকার গেণ্ডারিয়া পর্যন্ত চার কিলোমিটার রেলপথ নিম্নমানের। এ পথের আমূল সংস্কার করতে হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ট্রেন চলাচলের জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাওয়া থেকে জাজিরা প্রান্তসহ প্রথম ধাপে রাজধানীর কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনেই ব্যয় হবে কমপক্ষে ছয় হাজার কোটি টাকা। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেল সংযোগের জন্য এরই মধ্যে পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর-পুকুরিয়া-ভাঙ্গা অংশে ৬০ কিলোমিটার রেলপথ সংস্কার করা হয়েছে।
রাজধানীর কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্ত পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ৪৪ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। প্রস্তাবিত দোতলা পদ্মা সেতুর নিচের তলায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার, সেতুর জাজিরা প্রান্ত থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ হবে ৩১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, সিরাজদিখান, শ্রীনগর, লৌহজং, জাজিরা, শিবচর ও ভাঙ্গা উপজেলার ৮৮টি মৌজার ওপর দিয়ে রেলপথ বসাতে হবে। এসব স্থানে ৩৭৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, যার মধ্যে ২৭৩ হেক্টরই ব্যক্তি মালিকানাধীন। আর ৯২ হেক্টর ভূমি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের।
জানা গেছে, ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে প্রাথমিকভাবে পদ্মা নদীর ওপর সড়ক সেতু নির্মাণসংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদন করেছিল তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাতে রেলপথ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।-কালেরকণ্ঠ
মন্তব্য চালু নেই