সোনা চোরাচালান

‘নীল-নকশা’ আঁকেন সরকারি কর্মকর্তারাই

বাংলাদেশে সোনা চোরাচালান নতুন কিছু নয়। আগেও হতো, এখনো হচ্ছে। অবৈধ পথে আসা এসব সোনা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে বিমানবন্দর থেকে বাইরে পাঠানোর ‘নীল নকশার’ পুরোটাই আঁকেন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এমনকি বাংলাদেশ বিমান, সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজনও এর সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন ও ডিজিএমসহ চোরাচালান চক্রের ৫ নিয়ন্ত্রককে গ্রেপ্তারের পর মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এসব তথ্য জানতে পেরেছে বলে জানান গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম।

গ্রেপ্তার চক্রের মূল হোতা বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রু মাজাহারুল আফসার রাসেলকে চলতি মাসের ১২ তারিখে শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ২ কেজি ৬শ’ গ্রাম সোনা পাচারকালে আটক করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর উত্তরা ও বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ বিমানের চিফ অব প্ল্যানিং অ্যান্ড সিডিউলিং ক্যাপ্টেন আবু মো. আসলাম শহিদ, ডিজিএম মো. এমদাদ হোসেন, ম্যানেজার সিডিউলিং মো. তোফাম্মেল হোসেন, ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ ও উত্তরার ফারহান মানি এক্সচেঞ্জের মালিক মো. হারুন অর রশিদকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ (সিনিয়র এসি) মিনহাজুল ইসলাম।

গ্রেপ্তারকৃতদের দেয়া তথ্যের বরাদ দিয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত বেশকিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সোনা চোরাচালানের নীশ নকশা আঁকার দায়িত্ব পালন করেন। মূলত এরাই নির্ধারণ করে বিমানের কোন ফ্লাইটে কে যাবে, কার ডিউটি কোথায় থাকবে, কে কখন কীভাবে বিমান থেকে সোনা নামিয়ে শুল্ক গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইরে পাচার করবে।’

তিনি বলেন, ‘এই মামলার তদন্তে যাদের নামই আসবে, সে হোক যতোই ক্ষমতাশীল বা পদধারী তাদের গ্রেপ্তার করা হবে এবং আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’

বিমান বন্দরের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুবাইয়ে বসবাসকারী কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি এ দেশে সোনা পাঠানোর কাজ করেন। সিঙ্গাপুর, দোহা, হংকংয়েও এই পাচারকারী চক্রের লোকজন অবস্থান করে। মূলত এসব রুটে চলাচলকারী বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারীদেরও মোট অংকের টাকার বিনিময়ে কখনো চায়ের ফ্লাক্সে, কখনো বা জুতার ভেতর বা আরো কঠিন কোনো কৌশলে সোনার বার এ দেশে পাচার করে থাকে তারা। পরে বাংলাদেশের বিমান বন্দর পার করে দেয়ার দায়িত্বটি কয়েকটি দলের ওপর বিভক্ত করে দেয়া হয়। মূলত বিমান বন্দরে অস্থায়ী ভিত্তিতে যারা কাজ করে থাকেন তারা এসব সোনা বিমান থেকে নামানোর কাজ করে। এরপর বোর্ডিং ব্রিজের পাশের টয়লেটে সোনা রেখে আসা হয়। আরেকটি দলের কাজ টয়লেট থেকে বিমান বন্দরের বাইরে সেগুলো নিয়ে আসা। অন্য একটি দল পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারসহ অন্যান্য স্থানে ক্রেতাদের কাছে সোনার চালান পৌঁছানোর কাজ করে থাকে। পরিশ্রমের টাকাও সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে নেয় তারা।

যদিও সোনা চোরাচালানের সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাহকরা ধরা পড়ছে। মূল হোতারা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিদেশে বসেই এজেন্ট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে সোনা চোরাকারবাররা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সোনা পাচারের অর্ধশতাধিক মামলা প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেছে। তদন্তের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। সোনা চোরাচালানের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু এমন শাস্তি প্রায় কাউকেই ভোগ করতে হয় না।

কাস্টমস বিভাগের তথ্য মতে, গত এক বছরে সোনা আটকের শতাধিক ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫৮টি। বাকিগুলোর কোনো হিসাব থানায় নেই। বড় বড় চালানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ধরা পড়লেও তারা পার পেয়ে যাচ্ছে সহজেই। অনুসন্ধান বলছে, চোরাচালান আটকের জন্য সরকার ঘোষিত পুরস্কারের লোভেই এক শ্রেণীর কাস্টমস কর্মকর্তা কোনো মামলায় যাচ্ছেন না। এতে তারা অল্প সময়ের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোষাগার থেকে ১০ শতাংশ পুরস্কারের হিস্যা পেয়ে যাচ্ছেন।

সোনা চোরাচালানের অতীত পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা যায়, সোনা চোরাচালান অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেড়েছে কয়েক গুণ। গত এপ্রিলের শেষদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সোনা আমদানির শুল্ক ৬০ গুণ বাড়িয়েছে। এনবিআর বৈধ পথে আমদানি করা প্রতিভরি (১১ দশমিক ৬৬ গ্রাম) সোনা আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে ৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে, যা আগে ছিল মাত্র ১৫০ টাকা। এতে আরো বেড়েছে চোরাচালান।

এদিকে প্রতিবেশী ভারত সরকার সম্প্রতি সোনা আমদানিতে উচ্চ শুল্কহার আরোপ করেছে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ দিয়ে সোনা চোরাচালান বেড়ে যায়। কারণ বাংলাদেশে সোনা আমদানি শুল্ক ভারতের চেয়ে অনেক কম। এ সুযোগ গ্রহণ করতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের রুট ব্যবহার করে অবৈধভাবে সেদেশে সোনা নিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানা যায় বেশ কিছু সোনা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম খান বলেন, ‘এটা ঠিক, ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে সোনা আমদানি শুল্ক অনেক কম। আর এ সুযোগ নিচ্ছেন পার্শ্ববর্তী দেশের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছে। কিন্তু এখনো তা কার্যকর হয়নি। কেবল শুল্ক বাড়ালেই হবে না, সোনা চোরাচালান রোধে দরকার একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছি। অসংখ্যবার আবেদনপত্র দিয়েছি শিল্প মন্ত্রণালয়ে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা দ্রুত এই নীতিমালা ও তার বাস্তবায়ন চাই।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে দেশের বাইরে থেকে চোরাই পথে আসা আটক প্রায় ১২শ’ কেজি সোনা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রয়েছে। এর মধ্যে নিলাম হওয়া প্রায় ২৫৯ কেজি সোনা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যে ক্রয় করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; যা তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যোগ হয়েছে। বাকি প্রায় ৭৯০ কেজি সোনা ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ী খাতে জমা আছে।

সূত্রে জানা যায়, যে কোনো সংস্থার হাতে সোনা আটক হলে তা সরাসরি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই জমা করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক ও শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, সোনা আটক ও সংরক্ষণ এমন এক কঠোর প্রক্রিয়ায় হয় যে, পরিমাণ ও গুণগত মানে সামান্যও কমবেশি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা বা পুলিশ-বিজিবি যারাই সোনা আটক করুক; সেটি একাধিক সংস্থার উপস্থিতি, প্রমাণপত্র ও স্বচ্ছতাসাপেক্ষে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হয়। পরে পাঠানো হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ জুলাই দেশের বৃহত্তম সোনা চোরাচালানের ঘটনা ধরা পড়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কাঠমান্ডু থেকে আসা বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি এয়ারক্রাফট থেকে দুপুর ২টার দিকে ১ হাজার ৬৫টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। কেজির হিসেবে এই সোনার ওজন দাঁড়ায় ১২৪ কেজি ২১৬ গ্রাম। তিন মণ চার কেজি পরিমাণের এ সোনার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৫৪ কোটি টাকা।

তবে চলতি বছর সবচেয়ে বড় ও দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনার চালান ধরা পড়ে গত এপ্রিলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে এর টয়লেটের ভেতর থেকে ১০৬ কেজি সোনা উদ্ধার করেন কাস্টমস গোয়েন্দারা। এই সোনার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে ৪৭ কোটি টাকা।

একটি-দুটি বড় উদাহরণ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই ধরা পড়ছে সোনার চালান। এভাবে সোনা চোরাচালান অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেড়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ মাসে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের হিসাবে আটক সোনার পরিমাণ সর্বমোট ৬৩০ কেজি ৮৭৪ গ্রাম বা ১৮ মণ ২ কেজি ৮৭৪ গ্রাম। এটা গত পাঁচ বছরে জব্দ করা সোনার চেয়ে ২০ কেজি বেশি। এই সময়ে আটককৃত সোনার বাজার মূল্য প্রায় ৩শ’ কোটি টাকা।



মন্তব্য চালু নেই