নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাৎকার: ভালোবাসা, অর্থ, পুরস্কার আদায় করতে হয়

ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করার নয় দিনের মাথায় কবি নির্মলেন্দু গুণকেও স্বাধীনতা পদক দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে সরকার। এই মুহূর্তে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে তার এই পুরস্কার প্রাপ্তির পক্ষে বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের পক্ষ থেকে কবি ও প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিন তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি খোলামেলা ও অকপট অনুভূতির কথা জানান। তাদের অডিও আলাপচারিতার শ্রুতিলিপি এখানে প্রকাশ করা হলো।

রাজু আলাউদ্দিন: গুণদা, আপনাকে পুরস্কার পাওয়ার জন্য অভিনন্দন এবং আলিঙ্গন।
নির্মলেন্দু গুণ: তোমাকেও আলিঙ্গন হে মার্কেস।

রাজু: সর্বনাশ! আমাকে কেন গুণদা, তাও মার্কেস বলে!
গুণ: তুমি তো আমাদের লাতিন আমেরিকান।

রাজু: আমি খুব খুশি হয়েছি শেষ পর্যন্তু আপনি ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমে পুরস্কারটি পেলেন বলে।
গুণ: আমি চাইলাম বলেই তো এই পুরস্কারটার মূল্য বাড়লো, তাই না?

রাজু:অবশ্যই, অবশ্যই।
গুণ: এর আগে তো কেউ চায় নাই। সরকার দিত। আমি চেয়ে পদকের মূল্যটা বাড়িয়ে দিলাম। এটা প্রার্থিত পদক, নোবেল পুরস্কারের মতোই প্রার্থিত পদক। আমি চাই এটা সসম্মানে সচল থাকুক। আমাকে বাদ দিয়ে এটা সসম্মানে সচল থাকতে পারে না, ইন আদার ওয়ার্ড, তাই না?

রাজু: তা তো বটেই। পুরস্কার যখন কোনো প্রকৃত লেখককে দেওয়া হয় তখন পুরস্কারের মর্যাদা বাড়ে।
গুণ: আমি এটার মূল্যমান বাড়িয়ে দিলাম। এখন আমার সঙ্গে যারা অনায়াসে প্রাপ্ত হয়েছেন, সংগ্রাম না করেই পুরস্কারটা পেয়েছেন, তাদেরকে এখন আমার চেয়ে যোগ্য বলে ভাবা হবে।

রাজু: হা হা, হা।
গুণ: হা হা হা। অন্যরা ভাববে, এই লোকতো অনেক সংগ্রাম কইরা পাইছে, আর বাকিরা তো অনায়াসে পেয়েছে, তাদেরকে যেচে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে যে আমার সম্পর্ক সেটা ইন্টারেস্টিং পর্যায়ে সবসময় যাচ্ছে, আমি অসুখে পড়ার পর যখন ২০ লাখ টাকা দিছিল, সেটা কিন্তু তিনি আমাকে ডেকে দেন নাই, আমি এপ্লাই করেছিলাম।

রাজু: আচ্ছা, তাই নাকি?
গুণ: সবাইকে কিন্তু তিনি দেন। আমাকে কিন্তু তিনি দেন নাই। আমি কিন্তু তার নাম্বারে ম্যাসেজের পর ম্যাসেজ পাঠিয়ে, তাকে বিরক্ত করতে করতে এক পর্যায়ে ……

রাজু:বিরক্ত? হা হা হা।
গুণ: হ্যাঁ, বিরক্ত! হা হা হা। তিনি লোক পাঠাইছেন আমার কাছে। আমি তাকে বললাম, আইদার গিভ মি মানি অর সে সরি। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে কতটা বিরক্ত করতে পারি………..

রাজু: আপনি কি তাকে কথাবার্তার মাধ্যমে কৌশলগত ফাঁদে ফেলছেন বলতে চান?
গুণ: হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাতো বটেই। হা হা হা। আমাকে আগে সে ২০ লাখ টাকা দিছে, তাও সেটা ক্যাশ দেয় নাই, দিছে সঞ্চয়পত্র, আনসিন মানি। আমি বলছি দিস ইজ নট মানি। আই ওয়ান্ট টু সি দ্য মানি ইউ গেভ মি। আনসিন মানি ইজ নট মানি। যে টাকার যথেষ্ট খরচের স্বাধীনতা নাই, সেটাকে টাকা বলবো কী করে? ইউ ডিড নট গিভ মি দ্য ফ্রিডম। ইউ গেভ মি দ্য মানি বাট ইউ ডিড নট গিভ মি দ্য ফ্রিডম অব থিংকিং দ্যাট দিস ইজ মাই মানি। ব্যাংকের থেকে বাধ্য হয়ে সুদ খাইতে হবে, আমাকে সুদ খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। ইফ ইউ এলাউ মি….. আই ওয়ান্ট টু রিটার্ন ইট।

রাজু: পরে কি করলেন তিনি?
গুণ: তিনি বললেন, ইউ ক্যান নট রিটার্ন ইট।

রাজু: পরে কি উনি এটা ক্যাশ করে দিছেন?
গুণ: না, পরে আমি বললাম, ওকে স্যার, আই এ্যাম হ্যাপিলি একসেপ্ট ইট।

রাজু: যাক ভালো। আপনার অনুভূতি এখন তাহলে নিশ্চয়ই ভালো এই পুরস্কার পাওয়ায়? মানে আপনি ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমে এই যে পুরস্কার পেলেন এখন….
গুণ: টাকাও আমাকে আদায় করে নিতে হয়েছে। “নিজে থেকে তুমি দেও না কিছুই, ভীরু বেদনার একখানি জুঁই হাতে নিয়ে আসি, মুগ্ধ করার যতটুকু যায় ততটুকু ভালোবাসি।” মানে নিজ থেকে তুমি দাও না কিছুই, ভালোবেসে তবু একখানি জুঁই হাতে নিয়ে আসি। মানে ভালোবাসা আদায় করতে হয়, পুরস্কারও আদায় করতে হয়, অর্থও আদায় করতে হয়। এটা ভালো, ইট মেকস মি ডিফারেন্ট দ্যান আদারস। আমি বলছি যে আমার মতো কনফেশনাল ঘরাণার কবি আমাদের মধ্যে দর্শক পাঠকরা দেখে না বলে আমাকে নিন্দামন্দ, গালমন্দও করে। কিন্তু আমি ভিন্ন ধারার ভিন্ন ঘরাণার মানুষ, সেটা তারা বুঝতে পারে না। এ কারণে আমার রিয়েকশনের সাথে তাদের রিয়েকশনগুলো মিলবে না। আমার সঙ্গে তাদের রিয়েকশনগুলো যদি মিলেই তাহলে আলাদা হলাম কিভাবে! যদি আলাদা না হই– মার্কেসের একটা কথা আমার খুব প্রিয়, তিনি বলছিলেন– ইফ ইউ ওয়ান্ট টু চেঞ্জ দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ, ইউ চেঞ্জ ইউর লাইফ প্যাটার্ন।

রাজু: বাহ, ভালো বলছে।
গুণ: আমার জীবনের প্যাটার্ন যদি অন্য পাঁচজনের মতো হয়, তাহলে আমার ভাষাও অন্য পাঁচজনের মতোই হবে।

রাজু: তবে মার্কেসের এই বাণী শোনার আগেই তো আপনি আলাদা জীবন প্যাটার্ন তৈরি করে নিয়েছিলেন।
গুণ: হ্যাঁ, এটা আমার সঙ্গে মিলেছে। তার এই বাণী আমার কাছে পৌঁছানোর আগেই আমি সেটা করছিলাম।

রাজু: হ্যাঁ, তা তো বটেই।
গুণ: তার সমর্থন পেয়ে আমার ভালো লাগলো। যেমন আমি সেদিন আইনস্টাইনের জীবনী পড়তে গিয়ে এক জায়গায় দেখলাম মৃত্যু শয্যায় তাকে অপারেশন করার কথা বলা হয়েছিল, হি রিফিউজড ইট, রবীন্দ্রনাথ ডিড নট রিফিউজ। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু অনেক বেশি বয়সে মারা গেছেন, ৮১ বছর বয়সে। আর আইনস্টাইন মারা গেছেন ৭৬ বছর বয়সে। আইনস্টাইন বলছে, নো, আমি আর্টিফিসিয়ালি বেঁচে থাকতে চাই না। প্রকৃতি আমার মধ্যে যে জ্ঞান দিয়েছিল, আই মেড দ্য বেস্ট ইউজ অব ইট আই থিঙ্ক। আমি আর্টিফিসিয়ালি বেঁচে থাকতে চাই না। সো, হি ডাইড উইদাউট গোয়িং ফর দ্য অপারেশন। যারা জিনিয়াস বলে নিজেরে গোপনে ভাবে, আইনস্টাইনের কাছ থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করার আছে। আমরা যদি ভাবি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আরও একদিন লিখবো….. পারসোনালি আই ডোন্ট বিলিভ দ্যাট আই ক্যান রাইট বেটার দ্যান হোয়াট অলরেডি আই হ্যাভ রিটেন। আই ক্যান ইক্রিজ দ্যা নাম্বার অব বুকস, বাট আই ক্যান নট রাইট সামথিং নিউ। সো আই স্টপড রাইটিং। আই গট দ্য লেশন ফ্রম টেগর, অলসো ফ্রম শামসুর রাহমান… যে মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত আজীবন লিখে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই নিজের বিপুল লেখায় ঢাকা পড়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ যদি কম লিখতেন, তাহলে তাকে বেশি পড়া হতো, বুঝছ না?
রাজু:তা ঠিক।

গুণ: যেমন জীবনানন্দ দাশ কম লিখছেন বইলা তার কবিতা এখন বেশি পড়া হয়।

রাজু: তো আপনাকে আবারও অভিনন্দন গুন দা ……….
গুণ: তোমাদের একটা ছেলে ফোন করছিল আমাকে।

রাজু: হ্যাঁ, ওকে আমিই আপনার ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম, আপনার রিয়েকশন জানতে চাইছিল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে। দিয়েছিলেন তো, নাকি?
গুণ: হ্যাঁ, হ্যাঁ, দিছি, আমি বলছি যে আমি খুব খুশী। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল আসতে চাইছিল, আমি বলছি, না।

রাজু: ঠিকই আছে, ভালো করছেন। থ্যাঙ্কু গুণদা।
গুণ: তোমার বউয়ের খবর কী?

রাজু: বউকে কিছু মেডিক্যাল চেকআপ করার জন্য নিয়া আসছি ডাক্তারের কাছে।
গুণ: আবার বাচ্চা হবে কিনা–এই ব্যাপারে?

রাজু: না না না। ওরকম মনে হচ্ছিল যদিও।
গুণ: ভয় পাইছ নাকি আবার আরেক সন্তান আসবে বলে?

রাজু: না, তা না, তবে আমার তো আর দরকার নাই। আমি তো এমনিই আপনার চেয়ে এগিয়ে আছি।
গুণ: হা হা হা। তবে অনেকে আছে, অনেক সন্তান পছন্দ করে।

রাজু:আমি আপনার চেয়ে এক সংখ্যায় এগিয়ে আছি। আমার আর দরকার নাই। আপনি দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
গুণ: ওকে, ওকে, বাই। (সূত্র: বিডিনিউজ২৪)



মন্তব্য চালু নেই