পরিবারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা

‘নিখোঁজ’ সেই ৭ তরুণের ভাগ্যে কী ঘটেছে?

ডিসেম্বরে রাজধানীর বনানী থেকে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ চার তরুণ একটি রেস্টুরেন্ট থেকে একসঙ্গে খেয়ে বের হন। সেই বের হওয়াই ছিল তাদের শেষ খবর। আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তাদের, মুঠোফোনও বন্ধ।

প্রায় একই সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ‘নিখোঁজ’ হন আরও তিন তরুণ। পার হয়ে গেছে ৪০ দিন। কিন্তু এই ৭ তরুণের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর কোনো বাহিনীই।

এদিকে ‘নিখোঁজ’ কিংবা ‘অপহৃতদের’ পরিবারে বিরাজ করছে হতাশা, শঙ্কা আর উদ্বেগ। সন্তান ফিরে আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে চেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত মা-বাবা সন্তানের ফিরে আসার বিষয়টি সময়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।

তবে শুধু এই সাতজনই নয়, এর আগেও রাজধানী থেকে চিকিৎসক, ব্রিটিশ নাগরিক ও ব্যবসায়ীর নিখোঁজ হওয়ার রহস্যও অন্ধকারেই রয়ে গেছে।

এভাবেই অনেকটা রহস্যজনকভাবে ‘উধাও’ হয়ে যাচ্ছে আস্ত মানুষ! কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ‘হাওয়ায়’ মিলিয়ে যাচ্ছেন তারা। নিখোঁজদের মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শুধু গেল বছরই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন শতাধিক।

এদের মধ্যে গত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৮৮ জনকে তুলে নেওয়া হয়েছে; অভিযোগ স্বজনদের। আবার তারা ‘গুম’ না ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন, নাকি নিজেরাই ‘আত্মগোপন’ করেছেন; সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

সূত্র জানিয়েছে, নিখোঁজ সাত তরুণের তথ্য বিশ্লেষণ করে কয়েকজনের বিষয়ে সন্দেহজনক কিছু পেয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। বিশেষ করে চার তরুণের একযোগে নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক বলেই মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, তারা সন্দেহের বাইরে নয়। এর আগে দেখা গেছে, এভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে তাদের খুঁজে বের করতে পারলে প্রকৃত সত্য জানা যাবে।

নিখোঁজ তরুণদের খুঁজে পেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তবে তারা নিজেরা আত্মগোপন করেছেন নাকি অন্য কোনো চক্র তাদের অপহরণ করেছে; সে বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে গত ডিসেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, একজন ছাত্রীসহ বিশ্ববিদ্যালয়টির ১১ জন শিক্ষার্থী ছয় মাস ধরে ‘ক্লাসে নেই’। ‘নিখোঁজ’ ঘটনা সামনে আসায় নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশের সন্দেহ, নিখোঁজ তরুণরা স্বেচ্ছায় কোনো ধর্মীয় উগ্রপন্থি সংগঠনের সঙ্গে যোগ দিয়ে থাকতে পারেন। কারণ গুলশান হামলার পর অনেক ‘নিখোঁজ’ ঘটনায় দেখা গেছে, স্বেচ্ছায় পালানো তরুণরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন। আর গত ১ ডিসেম্বর বনানী থেকে চার তরুণের একসঙ্গে ‘নিখোঁজ’ হওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক।

গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসেন খান পাভেল, সুজন ও মেহেদী নামে চার তরুণ নিখোঁজ হন। এদের মধ্যে সাফায়েত ও পাভেল নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

আর গত ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর রংপুর এবং পাবনা থেকে পাবনা মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের দুই ছাত্র তানভীর আহম্মেদ তনয় ও জাকির হোসেন বিপ্লব নিখোঁজ হন। দুজনের বাড়িই রংপুরে। গত ১১ ডিসেম্বর জাকির বাড়ি ফিরলেও তানভীর এখনো ফেরেননি।

অন্যদিকে গত ৫ ডিসেম্বর বনানী থেকে নিখোঁজ হন সাঈদ আনোয়ার খান নামে এলাকার আরেক তরুণ। ‘ও’ লেভেলের এই শিক্ষার্থী কলাবাগানে একটি ক্যারাতে প্রতিযোগিতায় ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় নিখোঁজ হন।

৩০ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মাটিকাটার বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হওয়া কেয়ার মেডিক্যাল কলেজছাত্র ইমরান ফরহাদেরও কোনো হদিস মেলেনি। নিখোঁজ পাভেলের বাবা রাসেল খান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, কত কষ্টে ছেলেকে এই পর্যন্ত পড়িয়েছি তা বলে বোঝানো যাবে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি অনুরোধ, এখন ছেলেটাকে ফিরে চাই। আর কিছু চাই না। সুজনের ভাই সুমন জানান, তাদের বাবা পুলিশে চাকরি করেন, হার্টের রোগী। মেহেদীর শোকে ভেঙে পড়েছেন তিনি।

গত ১৪ জুলাই বনানী রেলস্টেশনের সামনে থেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইয়াসিন আলীকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ইয়াসিনের মা ডা. সুরাইয়া পারভীনের অভিযোগ, র‌্যাব-১-এর সদস্যরা তার ছেলেকে তুলে নিয়ে গেছেন। গত ১৪ অক্টোবর রাতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে অপহƒত হন লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের ডা. ইকবাল মাহমুদ (৩৫)।

গত ২৪ অক্টোবর রাতে উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের ৪০ নম্বর বাড়ি থেকে ডা. খালেদ হোসেনের ছোট ভাই তারেক হোসেনকে (৩৫) ধরে নিয়ে যায় কে বা কারা। এরপর তার কোনো খোঁজ নেই।



মন্তব্য চালু নেই