নায়কের ছেলে কৃষক! আজও কপালে জোটেনি একটি চাকরি আর মায়ের বিধবা ভাতা

সাক্ষরতা আন্দোলনের মহানায়কের পরিচয়ে চাকরি পাওয়ার আশায় তিন বছর বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে এলাকায় ফিরে গেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের যুবক আল-আমিন।

এলাকায় ফিরে শিক্ষিত যুবক আল-আমিন এখন অন্যের বাড়িতে কৃষি কাজ করে সংসারের হাল ধরেছেন।

ঘটনাটি ২০১৪ সালের। তখন আল-আমিনের দুর্দশাগ্রস্থ জীবন নিয়ে একটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয় থেকে ফোন করা হয় তাকে। এর পরপরই ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকেও ফোন করা হয় আল-আমিনকে। তাৎক্ষণিকভাবে এই দুই কার্যালয় থেকে ফোন পাওয়ার আশার সঞ্জার জাগে আল-আমিনের মাঝে। এবার বুঝি কিছু একটা হবে এই সম্ভাবনা কাজ করে তার মধ্যে। কিন্তু হতাশায় যেন তার চির সঙ্গী। কিছুই হয়নি আল-আমিনের। যেমনটি ছিলেন আগে, তেমনটি আছেন আজো।

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ফোন দেয়ার কিছুদিন পর জেলা প্রশাসক মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস আল-আমিনকে তার কার্যালয়ে ডেকে নেন। সেখানে আল-আমিন তার জন্য যোগ্যতামাফিক একটি চাকরি এবং মায়ের জন্য একটি বিধবাভাতার কার্ড দাবি করেন জেলা প্রশাসকের কাছে। জেলা প্রশাসক তার সঙ্গে বলে এসব দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। কিন্তু, এক বছর হতে চললো আল-আমিনের ভাগ্যে না জুটেছে একটি চাকরি। না জুটেছে তার মায়ের জন্য বিধবা ভাতার একটি কার্ড।

গত মঙ্গলবার রাতে এই প্রতিবেদকের মোবাইলে ফোন করেন আল-আমিন। এসময় তিনি বলেন, কই ভাইয়া, কিছুই তো হলোনা আমার।

করুন কণ্ঠে আল-আমিন জানায়, সাক্ষরতা দিবস এলেই সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন আমার বাড়িতে। সাক্ষরতা আন্দোলনের মহানায়ক নাকি ছিলেন আমার বাবা। অথচ তার ছেলে এখনও অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। আপনারাতো অনেক বড় সাংবাদিক কই আমার মায়ের জন্য তো একটি বিধবা ভাতার কার্ডও করে দিতে পারলেন না। কিছুদিন পর যখন আমার মা ভিক্ষা করতে বের হবে, তখন আপনারা আবারো হুমড়ি খাবেন আমার বাড়িতে।

তার সঙ্গে কথা শেষ করেই যোগাযোগ করা ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, তার মাকে বিধবাভাতার কার্ড দেয়ার জন্য বলে দিয়েছিলাম স্থানীয় চেয়ারম্যানকে। তিনি যে এখনো কার্ড পাননি সেটা আমার জানা ছিল না। আমি কালকেই (বুধবার) খোঁজ নিব তিনি কেন কার্ড পাননি।

কে এই আল-আমিন
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কচুবাড়ী কৃষ্টপুর এলাকাকে বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষর মুক্ত গ্রাম তৈরির মহানায়ক মোকছেদ আলীর একমাত্র ছেলে আল-আমিন।

মোকছেদ আলী
১৯৫৫ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী এলাকায় অভাবী এক পরিবারে জন্ম মোকছেদ আলীর। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় অধিক আগ্রহী হওয়ায় বাবার অভাবের সংসারের মাঝেও এইচএসসি পাশ করেন মোকছেদ আলী।

১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকার দেশব্যাপী সাক্ষরতা আন্দোলনের ডাক দিলে সবার আগে এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন কচুবাড়ী কৃষ্টপুর গ্রামের একমাত্র শিক্ষিত যুবক মোকছেদ আলী।

বাড়ির পাশেই পল্লী উন্নয়ন নামে একটি ক্লাবে স্থানীয় মানুষজনকে নিয়ে পাঠশালা গড়ে তুলেন তিনি। দিন-রাত একাকার করে বিনা পারিশ্রমিকে স্থানীয় মানুষজনকে নিরক্ষর মুক্ত করেন তিনি।

অন্যদিকে তার এই সফল উদ্যোগের কথা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। এরপর সরকারিভাবে সাক্ষরতার জরিপ শুরু হয় দেশ জুড়ে। সরকারের এই জরিপে বেড়িয়ে আসে বাংলাদেশের প্রথম নিরক্ষরমুক্ত এলাকা ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী কৃষ্টপুর গ্রাম এবং এই মহানায়কের নাম। এরপর সরকারিভাবে বাংলাদেশের সর্ব প্রথম নিরক্ষরমুক্ত গ্রাম ঘোষণা করা হয় এই কচুবাড়ী কৃষ্টপুরকে। তখন থেকে এই এলাকার নামকরণ করা হয় আদর্শ গ্রাম।

বাংলাদেশের হিমালয় ঘেষাঁ জেলা ঠাকুরগাঁওয়ের এই মহানায়ক মোকছেদ আলীর সফলতার চিত্র দেখতে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছুটে আসেন তার বাড়িতে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আসেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুব আলী, চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামসহ দেশ বরেণ্য আরো অনেকে।

মোকছেদ আলীর বাড়িতে এসে এলাকা জুড়ে তার ব্যাপক সফলতা দেখে খুশী হয়ে রাষ্ট্রপতি তাকে ঢাকায় চাকরির প্রস্তাব দেন। এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে চাকরি করার প্রস্তাবটি তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রপতিকে ফিরিয়ে দিয়ে তার পাশের এলাকার মানুষকে দ্রুত নিরক্ষর মুক্ত করার সহযোগিতা চান তিনি।

এরপর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঠাকুরগাঁও থেকে ফিরে এলাকা প্রেমিক মোকছেদ আলীকে ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত করেন তিনি।

অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে মোকছেদ আলীর দেশব্যাপী এই সফলতার কথা শুনে একই সালের ২৭ আগস্ট ঠাকুরগাঁওয়ের কচুবাড়ী এলাকায় আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর আগমনের কথা শুনেই অবহেলিত এই জেলার মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা শুরু হয়। সেই সঙ্গে এলাকায় শুরু হয় সাজগোজের প্রস্তুতি।

এর কিছুদিন পরেই ১৫ আগস্ট দেশ বরেণ্য নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর সংবাদে দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। একইভাবে শোকে কাতর হয়ে পড়েন কচুবাড়ী এলাকার মানুষজন। শোক কেটে আবারো এলাকায় নিরক্ষরতার যুদ্ধে নামেন মোকছেদ আলী। কোনো রকমের বেতন ভাতা না দিয়ে এভাবেই চলতে থাকে তার জীবন সংগ্রাম।

বাবার কাছ থেকে পাওয়া সামান্য কৃষি জমি চাষ করে সংসার চালিয়ে এলাকার মানুষের পাশে শিক্ষার প্রদীপ বহন করেন মোকছেদ আলী।

এভাবে কিছুদিন চলার ২০০০ সালের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরিবারে তখন স্ত্রী ও তিন সন্তান। অসুস্থতার মাঝে বড় মেয়ে আমিনা নুরীকে বিয়ে দেন তিনি।

এদিকে অসুস্থ এই মানুষটিকে নিয়ে হিমশিম খেতে শুরু করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।

বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাতে সব কৃষি জমি বিক্রি করে দেন ছেলে আল-আমিন। এক পর্যায়ে সব টাকা ফুরিয়ে গেলে ২০০৭ সালে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় রাষ্ট্রপতি পদক পাওয়া মোকছেদ আলীর।

বাবার মৃত্যুর পর ছোটো বোন আম্বিয়া খাতুনসহ মাকে নিয়ে অসহায় জীবন যাপন শুরু হয় আল-আমিনের। ১৯৯৯ সালে আলিম পাশ করা এই যুবক অন্যের বাড়িতে কাজ করে বোনের পড়ালেখা ও সংসারের হাল ধরেন।

মোকছেদ আলীর মৃত্যুর পর দেশের জন্য এই মানুষটির অবদানের কথা ঠাকুরগাঁওয়ের স্থানীয় সংবাদকর্মীরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তুলে ধরলেও আজো সরকারের কোনো দৃষ্টি পড়েনি এই পরিবারটির প্রতি।



মন্তব্য চালু নেই