নার্সিংহোমের বিল মেটাতে না পেরে প্রসূতির বাবার আত্মহত্যা

নার্সিংহোমের বিল মেটাতে পারবে না ভেবে প্রসূতির বাবার আত্মহত্যার ঘটনায় নার্সিংহোমের ৪ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় ফের শোকজ করা হয়েছে নার্সিংহোমটিকে। এ ব্যাপারে তদন্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরে পাঠিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর। ওই নার্সিংহোমে ভর্তি থাকা ১০–১২ জন রোগীর পরিবারের লোকেরা তাঁদের রোগীর চিকিৎসা না হওয়ায় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। তাঁরা নার্সিহোমে ডাক্তার, সিস্টার ও কোনও কর্মীকে দিনভর দেখতে না পেয়ে কীভাবে রোগী বের নিয়ে যাবেন তার কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না।

এই বর্ধমানের আরও একটি নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে বেশি টাকার বিল দেয়ার অভিযোগ উঠল। আরও গুরুতর অভিযোগ, যে নার্সিংহোমে মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার করার পরিকাঠামো নেই, সেখানেই জোসেফ মান্ডি নামে এক রোগীর মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। আরও অভিযোগ, বিগত তিনদিন ধরে তাঁর পরিবারের লোকদের রোগীকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। এক্ষেত্রেও রোগীকে রামপুরহাট হাসপাতাল থেকে বর্ধমান মেডিক্যালে স্থানান্তরিত করা হলে দালালেরা ওই পি জি নার্সিংহোমের পাশে রিলিফ নার্সিংহোমে ভর্তি করে।

কয়েকদিন আগে রামপুরহাট সরকারি হাসপাতাল থেকে চুমকি লেট নামে এক সদ্য প্রসূতিকে খিঁচুনি ও মাথার যন্ত্রণা নিয়ে দিন কয়েক আগে দালাল মারফতে ভর্তি করা হয় বর্ধমান শহর সংলগ্ন বর্ধমানের পি জি নার্সিংহোমে। সেখানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। রোগী সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁর বাবা তপন লেটকে ৪২ হাজার টাকার একটা বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই বিল মেটাতে গিয়ে মানুষের কাছে ধারদেনা করে ১৩ হাজার টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা আনতে তাঁর বাড়ি ঝাড়খণ্ডের মুলুটি গ্রামে ফিরে যান তপন বাবু। তারপর গ্রামে ফিরেও টাকা জোগাড় করতে না পেরে তিনি আত্মঘাতী হন। তারপর গ্রামে চাঁদা তুলে তাঁর প্রতিবেশীরা মেয়েকে ছাড়াতে বর্ধমানে আসেন শুক্রবার। তাঁরা নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে মেয়ের বাবার আত্মহত্যার ঘটনার কথা জানিয়ে বিল কমিয়ে মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান।

কিন্তু তাতে কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেননি বলে অভিযোগ। তখন জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে অভিযোগ জানালে জেলা শাসকের হস্তক্ষেপে বিলের পরিমাণ কমিয়ে ওই নারীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনার পরেই নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন। মাস দুয়েক আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে এই নার্সিংহোমটিকে শোকজ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে ফের নার্সিংহোমটি কোন রহস্যে চালু করা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনার পরেই শনিবার নার্সিংহোমের তিন মালিক জয়নাল আবেদিন, হাসিবুল কবির, আবদুল খতিম ও ম্যানেজার সৌভিক সাঁতরাকে বর্ধমান থানার পুলিশ আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছে।

আবদুল খতিম পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই নারী রামপুরহাট হাসপাতালে প্রথমে ভর্তি হওয়ার পরে সেখানে একটি সন্তানের জন্ম দেন। তারপর সেখান থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। বাড়িতে চুমকির শারীরিক অসুস্থতার কারণে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তখন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে রামপুরহাট হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারপর সেখান থেকে এখানে নিয়ে এসে ভর্তি করা হয়েছে। এখানে চারদিন আইসিসিইউ–তে ভর্তি ছিল। এরপর তাঁর বিল করা হলে ২০০০ টাকা জমা দিয়ে তাঁর বাবা বলে যান, বাড়ি থেকে ফিরে এসে বাকি টাকা দেব। কিন্তু ওই বিলের জন্য যে তিনি সেখানে আত্মহত্যা করেছেন, সেটা আমরা পরে জানতে পারি। বিল কমিয়ে তাঁকে ছুটিও দিয়ে দেওয়া হয়।

এই ঘটনায় জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. প্রণব রায় বলেন, ওই নার্সিংহোমটিকেই আমরা মাস দুয়েক আগে শোকজ করে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপর তাঁদের ভুল সংশোধন করে নেয়। ফের এই ঘটনার পরে আমরা তদন্ত করে একটি রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছি রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরে। এ প্রসঙ্গে জেলাশাসক ড.‌ সৌমিত্র মোহন বলেন, সরকারি নিয়মনীতি মেনে চলা উঠিত নার্সিংহোমগুলির। কিন্তু এক্ষেত্রে একটা সাংঘাতিকভাবে বিল করা হয়েছে শুনে আমি মুখ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। এই ধরনের অন্যায় ও অসাধু কাজ আমরা বরদাস্ত করব না। তাই নার্সিংহোমটিকে শোকজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বর্ধমানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নার্সিংহোম। রোগী ধরতে তারা দালালদের সাহায্য নিচ্ছে। অসহায় রোগীর পরিবার সেই দালালদেরই খপ্পরে পড়ছে। প্রসূতির মতো জোসেফ মান্ডি নামে ওই রোগীর ক্ষেত্রেও রামপুরহাট হাসপাতাল থেকে বর্ধমান মেডিক্যালে স্থানান্তরিত করা হয়। দালালেরা ভুলিয়ে ওই পি জি নার্সিংহোমের পাশে রিলিফ নার্সিংহোমে ভর্তি করে। কার্যত আদিবাসী পরিবার বলে কর্তৃপক্ষ তাঁদের পাত্তাই দিচ্ছেন না। তাই তাঁরা আদিবাসী সংগঠনের মাধ্যমে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কাছে অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. প্রণব রায় বিষয়টির ওপরে হস্তক্ষেপ করেন। তিনি দ্রুত নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষকে ডেকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী রোগীকে তাঁর পরিবারের লোককে দেখতে দিতে হবে। তিন-চারদিন আগে তাঁর অস্ত্রোপচারও হয়েছে। কিন্তু পরিবারের লোকেদের ওই রোগীকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। পাশাপাশি তাঁদের হাতে ৩ লক্ষ টাকার একটা বিল ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিল পাওয়ার পরে ৮৪ হাজার টাকা তাঁরা জমা দিয়েছেন। কিন্তু রোগীকে দেখতে না দেয়ায় পরিবারের লোকেরা দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। ‌‌

সূত্র: আজকাল



মন্তব্য চালু নেই