নারীর আকাঙ্ক্ষা কি কেবলই ধনী বর, চোখ ধাঁধানো ফ্যাশন আর ভারতীয় সিরিয়াল ?

সকাল সকাল আমার বরের পিছনে ঘুরে ঘুরে নাশতা খাওয়াতে হয়। আক্ষরিক অর্থেই অফিস যাওয়ার আগে বাচ্চাদের মত ঘর জুড়ে ছুটাছুটি করে, জোর করে খাইয়ে দিলে খায়। আবার খাওয়ার সময় নানান রকম সিনেমা করে “খাব না” টাইপ। (ঠিক যেভাবে রাত হলে আমি খেতে চাই না, কম্পিউটারে নাক ডুবিয়ে কি বোর্ড চাপি আর তিনি আমাকে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন) …

বিষয় সেটা না, বিষয় হলো এই বিষয়টা জানার পর একজন ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন-

– ছিঃ আপু, আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি!

– মানে? (আমি চোখ কপালে তুলে)

-আপনাদের মত স্বাবলম্বী মেয়েরাও যদি স্বামীর সেবা করে, তাহলে আর জীবনেও নারী জাতির উন্নতি হবে না। আপনারা বাইরে এত কিছু করে ঘরে স্বামীর দাসত্ব করেন? কাজের লোক দিয়ে করাবেন, নিজে করেন কেন।

-মানে কি। নিজের জীবনসঙ্গীকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া, অসুখে তাঁর দেখাশোনা করা, তাঁর ছোটছোট ব্যাপারে খেয়াল রাখা বা রান্না করে খাওয়ানো দাসত্ব?

-অবশ্যই! এত লাই দিয়েন না। ঘাড়ে উঠে গেলে নামাতে পারবেন না!

-তাহলে সে যে আমাকে দেখে-শুনে রাখে, আমার সব ছোট-বড় ভালো মন্দের খেয়াল রাখে, বলা মাত্র বাজারে দৌড়ায়, ডাক্তার দেখায়, খাইয়ে দেয়, যে কাজটা করতে আমার কষ্ট হবে সেগুলো সব করে দেয়, আমি গভীর রাত পর্যন্ত কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি সে বিন্দু মাত্র আপত্তি করে না, যে মানুষটা ভাবে আমার ক্যারিয়ারই প্রথমে… এইটা দাসত্ব না?

এটুক বলার পর দেখি আর মেসেজ যায় না। তিনি আমাকে ব্লক করেছেন! মানে বিষয়টা হচ্ছে, বরকে কাজের বুয়ার সাথে বিয়ে দিলেই তিনি বেশী খুশি হতেন। নিজের পরিবারকে রান্না করে খাওয়াই, এটা একটা বিশাল পাপ হয়ে গেছে। নিজের ক্যারিয়ার সামলে কেউ যদি নিজের পরিবারের জন্য কিছু করে, তাতে দোষটা কোথাও? নারী স্বাধীনতার অর্থ কি এটাই যে নিজের ঘর-সংসারের পরোয়া না করা?

একটা ব্যাপার আজও আমার কাছে পরিষ্কার না। নারী স্বাধীনতা বা অাধুনিকতার মানেটা আসলে কী? নিজের জীবনসঙ্গী, সন্তান আর পরিবারকে অবহেলা/অনাদর করে শুয়ে বসে দিন কাটানো? কিংবা নিজের জীবন নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকা যে আশেপাশের কোন আপনজনের জন্য কিছু না করা? একটা পরিবারে সকলেরই ভিন্ন ভিন্ন কর্তব্য থাকে। এটা পালন করায় দোষটা কী? নিজের পরিবারকে রেঁধে খাওয়ানোয় বা ঘর গুছানোয় কোথায় নারী স্বাধীনতা হরণ হয়? বরের টাকায় খেয়েপরে, সেজেগুজে নারী স্বাধীনতার বুলি কপচালেই কি নারী স্বাধীনতা হয়?

প্রিয় আপুরা,
স্বাধীনতা নিজের পায়ের দাঁড়ানোর মাঝে, আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার মাঝে। স্বাধীনতা প্রিয়জনদের পেছনে বা সামনে চলার মাঝে না, পাশাপাশি চলার মাঝে। পৃথিবীর জন্য কিছু করার মাঝে। নিজের দায়িত্ব নিজে বহন করার মাঝে, নিজের প্রয়োজন নিজে মিটিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার মাঝে। আধুনিকতা কাজের লোক রেখে নিজের সংসারের কাজ করানো আর নিজে কুঁড়ের বাদশা হয়ে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখার মাঝে না, আধুনিকতা জীবনসঙ্গীর মাঝে সকল দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার মাঝে। আধুনিকতা নিজের সন্তানদের শিক্ষায় ও মানসিকতায় উন্নত করে তোলার মাঝে, আধুনিকতা নিজের পরিবারের সাথে আন্তরিকতা রক্ষার মাঝে। স্বাধীন মানুষ নিজের চিন্তা-চেতনায় হয়, আর্থিক মেরুদণ্ড শক্ত করার মাঝে হয়, কারো ওপরে নির্ভরশীল না থাকার মাধ্যমে হয়। তাই না?

সবচাইতে ভয়াবহ বিষয়টা হলো,
আমাদের দেশে বেশিরভাগ নারীরাই নারী স্বাধীনতার মানে বুঝেছে আধুনিক পোশাক, কাজের লোক দিয়ে বাড়ি ভরে ফেলা, জীবন সঙ্গী ও পরিবারকে অবহেলা/অনাদর করা, স্বাধীনতার নামে উগ্রতা আর মারকুটে স্বভাবকে (যা নারী-পুরুষ কারো ক্ষেত্রেই কাম্য নয়)। নারী স্বাধীনতার মূল বিষয়টি যে নিজেকে উন্নত, সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিপূর্ণ মানুষ করে তোলার মাঝে আর পৃথিবীর বুকে নিজের অবদান রাখার মাঝে- এই ব্যাপারটি তাঁরা ধরতে পারেনি এখনো। আমাদের দেশে নারী স্বাধীনতা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মেলে না এমন আপত্তিকর পোশাক, ভারতীয় সিরিয়ালের খুবই সীমিত দুনিয়া আর মেকআপ-স্টাইলের আই ওয়াশে চাপা পড়ে গিয়েছে। খোলামেলা পোশাক আর চড়া মেকআপ নিলেই যে স্বাধীনতা হয় না, এটা কে বোঝাবে তাঁদের?

আমি কয়েকজনকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এরা সোশ্যাল বাটারফ্লাই, সারা দিন “লক্ষ্মী বউ” ইমেজ নিয়ে ফেসবুকিং করে আবার যেখানে চান্স পায় সেখানেই ঝগড়া করে। ফেসবুকটাও আজকাল এদের ঝগড়া করার জায়গা। স্টাইল আর ফ্যাশনে এদের জুড়ি মেলা ভার, কিন্তু কাজ করার বালাই নেই। চাকরি/ব্যবসা তো করেনই না, সংসারের কাজেও ঘোর আপত্তি। কয়েকজনের বাড়িতেও যাবার দুর্ভাগ্য হয়েছে। ফেসবুকে সিরিয়ালের মত লক্ষ্মী বউ সেজেই এরা সারা। একজনের বাড়িতে গিয়ে দেখি ৩ টা কাজের মানুষ, তাও ঘরদোরের অবস্থা গোয়াল ঘরের মত। এত বড় রাঁধুনি হিসাবে ফেসবুকে নাম করেছে, অথচ মেহমানদের রেঁধে খাওয়াল কাজের মেয়েরা! আরেকজনের বাড়িতে অবস্থা আরও ভয়াবহ। ক্লাস ২ তে পড়া মেয়ে সেই মহিলাকে রুটি টোস্ট করে জ্যাম মাখিয়ে এনে দিচ্ছে। মহিলা নিজে উঠে গিয়ে পানিও নিলেন না। তাঁর ছোট্ট মেয়েকে দিয়েই পানি আনিয়ে নিলেন! যেন কন্যা না, কাজের বুয়া! এটাই কি তবে নারী স্বাধীনতা?

বিয়ের জন্য ধনী পাত্র খুঁজে আর বরের টাকায় খেয়ে-পরে-আয়েশ করে “স্বাধীন” হওয়া যায় না, এটা বুঝতে আমাদের আরও কত সময় লাগবে কে জানে!

(প্রচ্ছদের ছবিটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত। আমাদের নারীরা হিন্দি সংস্কৃতির যে দিকগুলোতে আসক্ত, সেটা বোঝাতে।)



মন্তব্য চালু নেই