নাচ জীবনেরই প্রতিবিম্ব

বলা হয়, নাচ জীবনেরই প্রতিবিম্ব। মানুষের ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন বস্তু নিদর্শনের মতো নৃত্যকলার তেমন কোন বস্তু না পাওয়া গেলেও নৃত্যকলা প্রাচীন মানবের বিভিন্ন আচার উৎসবে নৃত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে প্রগৈতিহাসিককালে নৃত্যকলার প্রমাণ পাওয়া যায়। খৃষ্টপূর্ব ৩৩০০ সালে মিশরীয় দেয়াল চিত্রে এবং ভারতের গুহা চিত্রে নৃত্যকলার ভঙ্গী উৎকীর্ণ রয়েছে। দেয়ালচিত্রে খোদিত ভঙ্গীগুলো হতে মনে হয় যে কিংবদন্তীর কাহিনী পরিবেশনের জন্যই ওই চিত্রগুলো উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে লিখিত বর্ণমালা প্রচলনের আগে নৃত্যকলার এই পদ্ধতির মাধ্যমেই এই সব গল্প বংশ পরম্পরায় চলে আসতো ।

নৃত্যকলার আরো একটি প্রাচীন প্রকাশ দেখা যায় অতীন্দ্রিয় চেতনায় বিভিন্ন কু-প্রভাব হতে মুক্ত করার আচার অনুষ্ঠানে। নৃত্যকলার ইতিহাসে ভারতীয় নৃত্যকলা হচ্ছে প্রাচীন নৃত্যকলার অন্যতম । খৃষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের বহু ভারতীয় গ্রন্থে ভারতীয় নৃত্যকলার বিষয়ে বর্ণনা দেখা যায়।

আজ আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস। আধুনিক ব্যালের জনক জঁ জর্জেস নোভেরের জন্মদিন স্মরণে ১৯৮২ সালে দিনটির সূচনা করে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট। জাতি, ধর্ম, ভাষা ও রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্ব মানববন্ধনই দিনটি পালনের মূল উদ্দেশ্য।

গত ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা এই দিবসটি পালন করে আসছে। এ বছরও বর্ণাঢ্য আয়োজনে দিবসটি উদযাপন করছে বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা। ‘সন্ত্রাস রুখে দাও নৃত্যের ছন্দে’ শিরোনামে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার যৌথ আয়োজনে উদযাপন করেছে সপ্তাহব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা।

মূলত নাচের গুরুত্বকে স্বীকার করে নিতেই প্রবর্তন হয় আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসের। দিবসটি পালনের মূল উদ্যোক্তা নাচের আন্তর্জাতিক সংগঠন ওয়ার্ল্ড ড্যান্স অ্যালায়েন্স ও আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের নৃত্যবিষয়ক কমিটি। তাদের এই উদ্যোগকে পরবর্তীতে জাতিসংঘের শিক্ষা সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো গ্রহণ করে। ফলে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে নৃত্য দিবসটি উদযাপনের জন্য আহ্বান জানানো হয় ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে। কিন্তু কোন দিনটিকে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস হিসেবে পালন করা হবে, তা নিয়ে দ্বিধা থাকলেও পরবর্তীতে ঠিক করা হয়, ফ্রান্সের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী জ্যঁ জর্জ নভেরার জন্মদিনে পালন করা হবে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস।

বিশ্ব নৃত্যের দূত জ্যঁ জর্জ নভেরার জন্ম ১৭২৭ সালের ২৯ এপ্রিল প্যারিসে। তিনি ১৭৫৪ সালে ব্যালে নৃত্য আবিষ্কার করেন। নৃত্য সংস্কারক হিসেবেও ছিল তার খ্যাতি। নভেরা নৃত্যকে ক্ষুদ্র গন্ডি ও সঙ্কীর্ণতা মুক্ত করে অপেরায় উন্নীত করেন। তার Letters of dancing নৃত্যে নবযুগ রচনা করে। জ্যঁ জর্জ নভেরার অবদানের স্বীকৃতির মাধ্যমে একদিকে যেমন নৃত্যের জন্য বিশেষ একটি দিন নির্ধারিত হয়, তেমনি এই গুণী শিল্পীকেও শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ তৈরি হয়।

যে কোনো দেশের মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রেরণা হয়ে কাজ করে সে দেশের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষ বৃহৎ পরিসরে নিজেকে মেলে ধরতে পারে। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই একজন মানুষের যেমন, তেমনি একটি জাতির রুচিবোধেরও পরিচয় মেলে। সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়েই সংহতি, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতার বন্ধন তৈরি হয়।

সব সংস্কৃতির আদি জননী হচ্ছে নাচ বা নৃত্য। নাচ সাংস্কৃতিক শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। ফলে গবেষণা ও শিক্ষার উপাদান হিসেবে সারাবিশ্বেই নাচের জনপ্রিয়তা রয়েছে। নাচ মানুষের মেধা ও মননকে বিকশিত করে। নাচে দেহভঙ্গিমার মাধ্যমে শৈল্পিকভাবে পার্থিব ও অপার্থিব সব ভাবকে মানুষ প্রকাশের সুযোগ পায়। এই প্রকাশভঙ্গিতে থাকে গতি ও ছন্দ। সেই গতি ও ছন্দের তালে তালে ফুটে ওঠে প্রেম, ভালোবাসা, রাগ, অনুরাগ, প্রতিবাদ। সমাজ কিংবা গল্প ইতিহাসের কথাও নাচের মাধ্যমে উঠে আসে। নাচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা যায় জীবনের কথা, চাওয়া, পাওয়া বা না পাওয়ার কথা। সব মিলিয়ে নাচ শুধু বিনোদনমাত্র নয়। নাচ জীবনের প্রতিবিম্বও।



মন্তব্য চালু নেই