নতুন মানচিত্র পেতে আগামী জুন পর্যন্ত অপেক্ষা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘ ৬৮ বছরের জিইয়ে থাকা ছিটমহল সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে। এ সমাধানের পর পরিবর্তন আসছে দুই দেশের মানচিত্রে। বাংলাদেশের নতুন মানচিত্র প্রস্তুতের কাজ করছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি রেকর্ড এবং জরিপ অধিদফতর। বাংলাদেশের নতুন মানচিত্র পাওয়ার জন্য সামনের বছরের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল জলিল বলেন, ‘স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। এখন বাংলাদেশের মানচিত্রে সামান্য কিছুটা পরিবর্তন আসবে। এই পরিবর্তন এতটাই সূক্ষ্ম যে মানচিত্র বিশেষজ্ঞ ছাড়া অন্যরা বুঝবেন না। বাংলাদেশের নতুন মানচিত্র প্রস্তুতের কাজ চলছে, যা শেষ হতে সামনের বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

মো. আব্দুল জলিল বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে ১৪৫টি গুচ্ছগ্রাম (Interim Strip Maps) রয়েছে। ওই গুচ্ছগ্রামগুলোর সব মানচিত্রে দুই দেশের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের মহাপরিচালক পর্যায়ে স্বাক্ষর করা হয়েছে। এরপর দুই দেশের উচ্চপর্যায়ে ১৪৫টির মধ্যে ১৪৪টি গুচ্ছগ্রামের মানচিত্রে স্বাক্ষর করা হয়েছে। একটি নিয়ে সমস্যা রয়েছে। সামনে একটা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে বাকিটা চূড়ান্ত করা হবে।’

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের নতুন মানচিত্র চূড়ান্ত হলে সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের নতুন আয়তন নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ওই প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশের মোট কয়টি ছিটমহল, ছিটমহলগুলোর আয়তন পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার রাতে গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে জানায়, দুই দেশের প্রতিনিধিরা বৃহস্পতিবার ঢাকায় ছিটমহল সংক্রান্ত ৩০টি সীমানা মানচিত্রে (Interim Strip Maps) স্বাক্ষর করেন। ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ নিজ নিজ দেশের পক্ষে ওই মানচিত্রে স্বাক্ষর করেন।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে হওয়া স্থল সীমান্ত চুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে দুই দেশের মানচিত্রও ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী সংশোধন করা হবে। মানচিত্রে সীমানা নির্ধারণের কাজ দুই দেশের সরকারি জরিপ বিভাগ ২০১৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করবে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ছিটমহল বিনিময়ের পর যারা নাগরিকত্ব পরিবর্তন করতে চায় অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে ভারত বা ভারত থেকে বাংলাদেশ আসতে চায়- এরই মধ্যে তাদের তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। ওই তালিকা সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পররাষ্ট্র ও ভূমি মন্ত্রণালয় একসঙ্গে বসে যাচাই করবে। তারপর যারা ভারত যেতে চায় তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ কিভাবে স্থানান্তর করা হবে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক সিদ্ধান্ত নিয়ে স্থানান্তরের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করবেন। ওই স্থানান্তর প্রক্রিয়া সামনের নভেম্বরের মধ্যে শেষ হবে।

ছিটমহল বিনিময়ের নথিতে বলা হয়েছে, ‘ভারত এবং বাংলাদেশ এই মর্মে সম্মত হয়েছে যে, বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের যে ছিটমহল রয়েছে এবং বাংলাদেশের যে ছিটমহল ভারতের মধ্যে রয়েছে তা ১৯৭৪ সালের চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী বিনিময় হবে, যা ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাত থেকে কার্যকর হবে। ছিটমহলবাসীর জাতীয়তা এবং নাগরিকত্ব ১৯৭৪ সালের চুক্তি এবং ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। ছিটমহল এলাকায় বসবাসরতরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী নাগরিকত্ব লাভের অধিকার পাবেন। নাগরিকত্ব লাভের এই অধিকার তারাই পাবেন যাদের নাম ২০১১ সালের জুলাই মাসে দুই দেশের যৌথভাবে করা গণনাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পাশাপাশি ২০১১ সালের শুমারিতে অন্তর্ভুক্তদের পরবর্তী সময়ে প্রসব করা সন্তানরাও এ অধিকার পাবেন। নিরাপদে এবং সহজে ছিটমহলবাসীর স্থানান্তর এবং তাদের সম্পদের স্থানান্তরের বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারত সরকার নিশ্চিত করবে।’

নথিতে আরও বলা হয়েছে, ‘ছিটমহল থেকে যে সকল অধিবাসী বাংলাদেশ বা ভারতের ভূখণ্ডে বসবাস করতে চান তাদের এ বসবাসের ব্যবস্থা সমঝোতা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা করবে, যা ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে করতে হবে। এ ক্ষেত্রে হলদিবাড়ী, বুড়িবাড়ী এবং বাংলাবান্ধা এই সীমান্ত দিয়ে এ প্রক্রিয়া কার্যকর হবে। যেকোনো ধরনের সমস্যা ২০১১ সালের প্রটোকল অনুযায়ী সমাধান করা হবে।’

ছিটবাসীদের সম্পদ স্থানান্তর সম্পর্কে নথিতে বলা হয়েছে, ‘ছিটমহলবাসী ভারত বা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে স্থায়ী সম্পদ হস্তান্তর করতে চাইলে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাইয়ের আগেই সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় নথিপত্র দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার নিরাপদে স্থায়ী সম্পদ হস্তান্তর বা বিক্রির ব্যবস্থা করবে। দুই দেশের যৌথ সীমান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ এ স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সবকিছু চূড়ান্ত করবে। ২০২০ সাল পর্যন্ত ছিটমহলবাসীর স্থানান্তর বা এ সংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে তা দুই দেশের যৌথ সীমান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ সমাধান করবে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি ও ২০১১ সালের প্রটোকল অনুসমর্থনের দলিল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (ভারতে থাকা) পাচ্ছে ভারত এবং ভারতের ১১১টি ছিটমহল (বাংলাদেশের মধ্যে থাকা) পাচ্ছে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশ পাচ্ছে প্রায় ১৭ হাজার ১৬০ একর জমি। আর ভারত পাচ্ছে ৭ হাজার ৭১০ একর জমি। এতে মূলত বাংলাদেশ পাচ্ছে প্রায় ১০ হাজার একর বাড়তি জমি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সফরে দুই দেশের ৬৮ বছরের জিইয়ে থাকা স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন ঘটে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি ও ২০১১ সালের প্রটোকল অনুসমর্থনের দলিল গত ৬ জুন বিনিময় করেন। ওই সময়ের ঐতিহাসিক মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই