নতুন বিদ্যুৎ যন্ত্র উদ্ভাবন: খরচ ২০ পয়সা!

সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুরের মো. জালাল উদ্দিন। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের কনিষ্ট সন্তান। ছোটবেলা থেকে তিনি একটু দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। সব সময়ই নতুন কিছু আবিষ্কারের চেতনায় থাকতেন তিনি। সেই লক্ষ্যে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছে ছিল তার। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। তবুও থেমে নেই তিনি। ১৯৯২ সালে শাহজাদপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর জীবিকার সন্ধানে ১৯৯৩ সালে রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে যোগ দেন।

এরপর চাকরিরত অবস্থায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। আর তাতে তার আবিষ্কারের অবচেতন মন আবারও জেগে ওঠে। এরই মধ্যে তিনি দেশের মানুষের বড় সমস্যাগুলো খুঁজে বের করেন। আর সেই সমস্যার মধ্যে তিনি বেছে নিলেন বিদ্যুৎ সমস্যা। তখন থেকে কীভাবে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় সেই চিন্তায় মেতে উঠলেন তিনি।

অবশেষে সফল হলেন তিনি। উদ্ভাবন করেছেন নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্র। যার নাম দিয়েছেন তিনি ‘ফেরাল জিম’। আর তার এ আবিষ্কৃত যন্ত্রটি দিয়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উতপাদন খরচ পড়ছে মাত্র ২০ পয়সা। তিনি এ যন্ত্রটি আবিস্কার করে একটি ছোট প্রকল্প করেছেন নাটোরের বড়াইগ্রামে। প্রকল্পটির নাম দিয়েছেন ‘জুনায়েদ পাওয়ার লিমিটেড’।

তিনি তার এই উদ্ভাবনকে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে চান। কিন্তু কীভাবে? কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্র আবিষ্কার করলেও আর্থিক অস্বচ্ছলতাই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার। তাই তিনি আর এগুতে পারছেন না। যদি সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে তাহলেই তার এই উদ্ভাবন হয়তো দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে আসবে।

জালাল জানিয়েছেন, তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করে ফ্লাই হুইল এনার্জি, ইলেক্ট্রিক্যাল এনার্জি, রেশিও এনার্জি, এসেন্ট অ্যান্ড ডিসেন্ট এনার্জি, লেভেল এনার্জি, গ্রেভিশন এনার্জি অ্যান্ড মেকানিক্যাল এনার্জিসহ বিভিন্ন প্রকারের শক্তিকে সমন্বয় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেছেন। তিনি তার নাম দিয়েছেন ‘ফেরাল জিম’ । ‘উদ্ভাবিত ফেরাল জিম’ যন্ত্র দিয়ে বাহিরের যে কোন শক্তি জ্বালানি হিসাবে ১০ মিনিট ব্যবহার করলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তি পূণঃচক্রাকার (রি-সাইকেল) পদ্ধতিতে ৪০ শতাংশ উক্ত মেশিনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হবে। আর অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ বিক্রয় করা যাবে। আবিষ্কৃত মেশিনের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সরবরাহ রেশিও ৩ অনুপাত ২। উদ্ভাবিত যন্ত্রটি সম্পূর্ণ বায়ু ও শব্দ দূষণমূক্ত এবং পরিবেশ বান্ধব বলে জানিয়েছেন জালাল উদ্দিন।

তিনি জানান, প্রতি ৫ (পাঁচ) মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যন্ত্রটি তৈরিতে খরচ পড়বে দেড় মিলিয়ন মার্কিন ডলার। মেশিনের ওয়েস্টেজ খরচ এবং পরিচালনার খরচ বাদ দিয়ে প্রতি ইউনিট বা কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ মাত্র ২০ (কুড়ি) পয়সা।

জালাল উদ্দিন জানিয়েছেন, গ্যাস, ডিজেল, ফার্নেস ওয়েল, কয়লা, সোলার, জলবিদ্যুৎ এবং পরমাণু ইত্যাদি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের খরচের চেয়ে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক কম। উদ্ভাবিত বিদ্যুতে উৎপাদন যন্ত্রে কোনো প্রকারের ঝুঁকি নেই। কেননা ঝুঁকিপূর্ণ বিস্ফোরক জাতীয় কোন প্রকারের পদার্থ মেশিনের ভিতরে এবং বাইরে কোথাও ব্যবহার করা হয়নি। প্রযুক্তির মেশিনে মেকানিক্যালে ফ্রিকশন লস ধরা হয়েছে বি-বেল্ট ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ, চেইন পিনিয়নে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং স্পার গিয়ারে ১ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয় ১ দশমিক ৮ এইচপি (হর্স পাওয়ার) অথবা শূন্য দশমিক ৭১৯ থেকে ১ দশমিক ২৬৯ কেএন (কিলো নিউটন) রোটেশন প্রেসার (ঘূর্ণায়ন চাপ)।

উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মেশিনে সমস্ত প্রকারের ফ্রিকশন লস বাদে প্রতি কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য শক্তির যোগান দেওয়া হয়েছে ১২ এইচপি। প্রতি ৫ (পাঁচ) মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য অলটারনেটর লাগবে ৯৫০০ কিলোওয়াট। অলটারনেটরের দক্ষতা ৯০ শতাংশ হিসাবে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ৮৫৫০ কিলোওয়াট। আবিষ্কৃত মেশিনে ড্রাইভিং এর জন্য ৫০০ হর্স পাওয়ারের ২টি মটর অটো টাইমারে ১০ ঘন্টা করে চলমান থাকবে। এইভাবে ফেরাল জিম যন্ত্রটি ২৪ ঘন্টাই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে থাকবে। উদ্ভাবিত মেশিনের উৎপাদিত বিদ্যুৎ পূণঃচক্রাকার (রি-সাইকেল) ভাবে ২টি মটরের জন্য জ্বালানী হিসাবে বিদ্যুৎ থাকবে ৩৫৫০ কিলোওয়াট। সরবরাহ লাইনে বিদ্যুৎ সরবরাহ হবে ৫ হাজার কিলোওয়াট (৫ মেগাওয়াট)। এই প্রযুক্তিতে ৫ (পাঁচ) মেগাওয়াট যন্ত্রটি স্থাপন করতে জায়গা লাগবে ২৮৮ বর্গফুট।

জালাল আরও জানান, আবিষ্কৃত প্রযুক্তির মেশিনের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ‘জুনায়েদ পাওয়ার লিমিটেড’ কোম্পানিটি বর্তমান ৩৫ লাখ টাকা খরচ করে ২৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি মেশিনের কাজ শেষ করেছে। আর্থিক সমস্যার কারণে উক্ত মেশিনে ১০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ বা লোড হচ্ছে এবং মেশিনটি বর্তমানে চলমান আছে।

নিরাপত্তা সহ বাংলাদেশ সরকার এই বিদ্যুৎ উতপাদন যন্ত্রে আর্থিক সহায়তা দিলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করে বিদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা যাবে বলে জানান প্রযুক্তির উদ্ভাবক জালাল উদ্দিন।



মন্তব্য চালু নেই