ধোঁয়াশা ছড়ান কেন?

গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চরম এক অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছি। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনেকের সংগে আমিও আছি আটকা পড়ে। আছি অহর্নিশ উৎকণ্ঠার মধ্যে। ফেসবুক চালানোর মতো স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও মানসিক অবস্থা যে নেই, সে কথা বলাই বাহুল্য।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঘেরাটোপ নিরাপদ হবার কথা। কিন্তু গেল পাঁচ তারিখে আটকা অবস্থায় ফটকের ওপর দিয়ে অফিসের ভেতরে অবরুদ্ধ সকলের ওপরে তারা যেভাবে নিষিদ্ধ পিপার স্প্রে দফায় দফায় ছুঁড়েছে এতে ম্যাডাম জিয়া থেকে শুরু করে আমরা সকলে কমবেশি অসুস্থ হয়ে পড়ি। এরপর থেকে আর ভরসা করা যাচ্ছে না। উৎকণ্ঠিত না হয়ে উপায় থাকছে না।

সাংবাদিকতা বরাবর এক ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে জীবনে অনেকবারই ছোটবড় হরেক ঝুঁকিতে আমিও পড়েছি। তবে এবারের অভিজ্ঞতাটা একটু অন্যরকম। বাইরে এখনো শতাধিক পোশাকি-সাদা কাপড়ের সান্ত্রী-সেপাই মোতায়েন। আছে অবরোধী ট্রাক ও ওয়াটার ক্যানন। বালু-পাথরের ট্রাকের বহরটা কেবল সরেছে। তবে ফটকে পুলিশের তালা মারা-তালা খোলার নাটুকে সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছে হরহামেশা। উদ্বেগ জানাতে আসা নাগরিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি ও শৈথিল্যও চলছে তাদের খাম-খেয়ালিতে।

মিডিয়া এখন কঠিন সেন্সরশিপের ধারালো খাঁড়ার তলে কম্পমান। কর্তাদের পছন্দের ও বাছাইকৃত খবর ছাড়া আর কিছু প্রচার ও প্রকাশে বারণ আছে। তাই প্রায় একতরফা ও একদলীয় রাজনৈতিক প্রচারণার বাহন হতে হয়েছে দেশের গণমাধ্যমকে। এমন শক্ত বাঁধনের কুফল সবাই জানলেও মানতে চায় না কেউ।

এ দশার মধ্যে আমার তেমন কাজ নেই। মেইন স্ট্রিম ও অনলাইন মিডিয়ায় খবরাখবর দেখে কাটাই বেশিরভাগ সময়। এর মধ্যেই ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রেসিডেন্ট অমিত শাহের সঙ্গে ম্যাডাম জিয়ার টেলিফোন আলাপের বিষয়টি মিডিয়ার মাধ্যমে জানিয়ে দিতে বলা হয় আমাকে। আমি যথারীতি তা পালন করি। পরদিন এ নিয়ে শুরু হলো উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার এক মস্ত ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

সরকার অনুগত প্রচারমাধ্যম এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকরা এ নিয়ে এমন তোলপাড় করবেন এবং নার্ভাস রিয়্যাকশন ব্যক্ত করবেন তা সুস্থ মাথায় কল্পনা করা যায় না। এ কারণে আমাকে এ সবের জবাব দিতে হয়েছে। কিন্তু আমি দারুণ মর্মাহত এই ছোট্ট একটি ঘটনাকে ঘিরে এক শ্রেণীর মিডিয়ার ভূমিকায়।

তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের দেশের রাজনীতিকদের বক্তব্যের ধাঁচ-ধরণ নিয়ে আমরা সবাই অবহিত। এ নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই। তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও স্বার্থ থাকে। সেই উদ্দেশ্য ও স্বার্থ রক্ষায় তারা সময় বুঝে কথা বলেন, বিপাকে পড়লে তা অস্বীকার করেন, ভুল তথ্য দেন, ভুল প্রতিবাদও তারা করে থাকেন। সে কারণে সাংবাদিক হিসেবে আমরা শিখেছি তাদের কথা প্রচারের আগে পেশাদার পন্থায় যাচাই করে নিতে। প্রচারণা ও তথ্যের মধ্যকার ফারাক বুঝতে পারাটা সাংবাদিকতার একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা। কাজেই মিডিয়া কখনো কোনো পক্ষ-বিপক্ষের প্রচারবিদের ভূমিকায় নামতে পারে না।

সাংবাদিকতায় হাতেখড়ির সময় থেকেই এ শিক্ষাটা পেয়েছি বলে কোনো তথ্য প্রচারের আগে তার সত্যাসত্য যাচাই করে নেয়াটা আমার সহজাত প্রবণতা। কেননা সাংবাদিকতা পেশাটাই হচ্ছে সত্য অনুসন্ধান ও প্রকাশের পেশা। সেটা আজীবন সততার সঙ্গে চোখের মণির মত রক্ষা করে এসেছি। তথ্য প্রকাশে অসাবধানতাবশত: কখনো ভুলচুক হয়ে থাকতে পারে কিন্তু সততাকে কখনো বিসর্জন দিইনি।

সেই আমাকে যখন আজ প্রশ্নবিদ্ধ করার এবং আমি সত্য তথ্য না দিয়ে মিথ্যাচার করেছি বলে যখন প্রমাণের অপচেষ্টা চলে, তখন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ রোধ করা যায় না। আমি আবারও সকলকে বিশেষ করে সমপেশার যে বন্ধুরা আমাকে দীর্ঘকাল ধরে নিবিড়ভাবে চেনেন তাদেরকে বলবো, আমি মিথ্যা বলি কিনা, মিথ্যা বা ভুল তথ্য কখনো দিই কিনা। অন্তত: আপনারা তা জানেন। বিনা তথ্য-প্রমাণে বা নিশ্চিত না হয়ে আমি কোনো তথ্য কখনো দিই নাই, ভবিষ্যতেও দেব না। ম্যাডাম জিয়ার সঙ্গে বিজেপি প্রধানের টেলিফোন আলাপের ব্যাপারেও আমি শতভাগ জোর দিয়ে সেই অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি। সেই সঙ্গে দুঃখের সঙ্গে এ কথাও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমার যে বন্ধুরা মহল বিশেষের রাজনৈতিক প্রদাহকে নিবারণের উদ্দেশ্যে আমাকে ‘মিথ্যুক’ প্রমাণের জন্য অপকৌশল ও অপসাংবাদিকতার আশ্রয় নিয়েছেন তারা খুবই অন্যায় ও অন্যায্য কাজ করেছেন।

শ্রীযুক্ত অমিত শাহ্‌ দিল্লির বাইরে সফররত থাকলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ আধুনিককালে অসম্ভব নয়। লতায় পাতায় না ঘুরে সরাসরি তাকেই জিজ্ঞেস করুন ম্যাডাম জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে তার কথা হয়েছে কিনা। মেহেরবানি করে ধোঁয়া ছড়িয়ে কারো স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের পেশাকে কলঙ্কিত করবেন না।

[সংগৃহীত]



মন্তব্য চালু নেই