ধর্ষণের পর যা যা করণীয়!
নারী স্বাধীনতা বাড়ার সাথে সাথে বিশ্বে ধর্ষণের সংখ্যাও বাড়ছে দ্রুত গতিতে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়।
প্রতি ২২ মিনিটে ভারতের কোথাও না কোথাও একটি মেয়েকে যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদেশসহ প্রায় সারা বিশ্বেই বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা, তাও আবার অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। আশ্চর্যের বিষয়, পশ্চিমা বিশ্বে, যেমন জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
স্বাভাবিকভাবেই ধর্ষণের মতো দুঃস্বপ্ন কোনো মেয়েই দেখতে চান না। ধর্ষণের পর যে কোনো নারী এতটাই লজ্জিত এবং আতঙ্কিত থাকেন, যে তিনি ধর্ষক সম্পর্কে কোনো কথা বলতে বা পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন।
‘অনেক ধর্ষিতা নারীরই বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায় নিজের জীবনে ধর্ষণের মতো দূর্ঘটনার কথা কারো কাছে সরাসরি বলতে।’ এই মন্তব্য স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস’র, যিনি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে এবং দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা বা ‘মেডিকেল টেস্ট’র ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত।
শ্লীলতাহানির শিকার নারীরা জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট শহরে অবস্থিত ঐ সংস্থাটিতে নিজেদের অসহায়ত্ব ভুলে সাহায্য নিয়ে থাকেন। ধর্ষণের মামলা যাতে ভালোভাবে নথিভুক্ত করা যায়, অপরাধীদের যাতে শাস্তি হয় এবং নিগৃহীত নারী যাতে মানসিকভাবে কম কষ্ট পান, সেজন্য তাঁদের দ্রুত এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ‘মেডিকেল টেস্ট’র প্রয়োজন হয়, জানান ডা. পিলস।
ফ্রাংকফুর্টের ঐ সংস্থাটিতে গুরুত্বপূর্ণ এই ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পর্কে সব রকম তথ্য পাওয়া যায়। ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয়- এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় বেশ কিছু ‘উপদেশ’ দেওয়া হয়েছে।
সেগুলি হলো :
# ধর্ষণের পর একা থাকবেন না, কোনো বান্ধবী বা আত্মীয়ার সাথে যোগায়োগ করুন, ঘটে যাওয়া ধর্ষণ নিয়ে কথা বলুন এবং তাঁর সাহায্য নিন।
# গোসল, খাওয়া-দাওয়া, ধূমপান, বাথরুম যাওয়া – সম্ভব হলে এ সব বন্ধ রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের কাছে চলে যান। অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুছে যাবার আগেই ডাক্তারি পরীক্ষা করান।
# হাসপাতালে যাওয়ার পর যদি ‘এমারজেন্সিতে’ কারো সাথে এ বিষয়ে কিছু বলতে না চান, তাহলে শুধু ‘আমাকে এক্ষুনি একজন স্ত্রী বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে হবে’ – এ কথা বললেও চলবে।
# ধর্ষণকারী যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, তার সব তুলে রাখুন। যেমন অন্তর্বাস, প্যাড ইত্যাদি৷ সম্ভব হলে এ সব জিনিসের ছবিও তুলে রাখুন।
# নিজেকে দোষী ভাববেন না। কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে, শুধু সে একাই এর জন্য দায়ী, অপরাধী৷ আপনি নন।
হাইডেলব্যার্গ, মিউনিখ, ড্যুসেলডর্ফ, হামবুর্গ, হানোফার মতো জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরে রয়েছে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন বিষয়ক জরুরি বিভাগ। সেখানে জরুরিভিত্তিতে ডাক্তারি পরীক্ষা বা ‘মেডিকেল টেস্ট’ করা হয়ে থাকে। হাইডেলব্যার্গের ধর্ষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের প্রধান ডা. ক্যাথরিন ইয়েন বলেন, ‘জার্মানিতে যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের পর যে সমস্যা হয়, তা সমাধান করার জন্য অঞ্চল বিশেষে রয়েছে বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা। এগুলি ধর্ষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররাই ভালোভাবে চিনতে এবং নথিভুক্ত করতে পারেন।’
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণ বিষয়ক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে জার্মানিতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’ (www.hilfetelefon.de) বা ‘নারীর প্রতি নির্যাতন’ নামের একটি সংগঠন, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়। এখানে নারীরা তাঁদের নিজের পরিচয় গোপন রেখেই নিজেদের সমস্যার কথা বলতে পারেন।
এছাড়া ধর্ষণের পর নারীদের পরীক্ষা করার বিশেষ সুবিধার জন্য জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট শহরের সাতটি হাসপাতালে আলাদা বিভাগ রয়েছে। যেখানে আছে ডিএনএ পরীক্ষাসহ ধর্ষণের চিহ্ন নিশ্চিত করার বিশেষ কিছু ব্যবস্থা। এ সব আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে ধর্ষককে চিহ্নিত করে ও তার বিরুদ্ধে দ্রুত মামলা করা সহজ। শুধু তাই নয়, কোনো নারী যদি বলেন যে ধর্ষণের সময় তিনি ধর্ষককে নখের আচড় বা খামচি দিয়েছেন, তাহলে পরে তাঁর নখ কেটে পরীক্ষা করেও ধর্ষকের চিহ্ন পাওয়া সম্ভব।
স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. পিলস বলেন, ধর্ষকের কোনো অসুখ ছিল কিনা বা সে এইচআইভি আক্রান্ত ছিল কিনা – এ সব যথ দ্রত জানা যায়, ততই মঙ্গল। আর এর জন্য যত তাড়াতাড়ি ঐ ‘মেডিকাল টেস্ট’ টি হওয়া প্রয়োজন। ধর্ষণের ফলে কোনো নারী গর্ভবতী হলে, সেটা দ্রুত আটকানোর পন্থাও (একটা সাধারণ ট্যাবলেটের মাধ্যমে) নেওয়া সম্ভব একমাত্র সঠিক সময়ে ঐ ডাক্তারি পরীক্ষাটি সম্পন্ন হলে।
তাছাড়া যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে ‘গ্রুপ থেরাপি’, যার সাহায্যে নারীরা সহজে আবারো সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দূর্ঘনাটি সহজে ভুলতে পারেন।
অবশ্য বলা বাহুল্য, এর জন্য শুধু ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ।
মন্তব্য চালু নেই