দেশের সবচেয়ে ক্ষুদ্র মসজিদ

দেশের অন্যতম বৃহত্তম রেলওয়ে জংশন বগুড়ার সান্তাহার শহর থেকে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার দুরে অবস্থিত তারাপুর গ্রাম। এর থেকে দুই কিলোমিটার দুরে অবস্থিত আরেকটি গ্রামের নাম মালশন। গ্রাম দুইটিতে রয়েছে দেশের সবচেয়ে ছোট দুইটি মসজিদ। যদিও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অবহেলা অযত্নে আজও ঐতিহাসিক প্রাচীন নিদর্শন দুইটির সংরক্ষণ বা দেখভাল শুরু হয়নি। মসজিদের একটিতে এক সঙ্গে ৩ জন এবং অপরটিতে ৫ জন নামাজ পড়া যায়। একথা প্রায় নিশ্চিত এর চেয়ে ছোট কোনো মসজিদের সন্ধান আজও দেশের কোথাও পাওয়া যায়নি।

ঐতিহাসিক নিদর্শনের গ্রাম তারাপুর ও মালশনের অবস্থান বগুড়ার সান্তাহার শহর এলাকার মধ্যে। রেলওয়ের ব্রডগেজ রেললাইন পার হয়ে তারাপুর গ্রামে ঢুকতে প্রথমে দেখা মেলে তালুকদার বাড়ি। তালুকদার বাড়ি পেছনে ফেলে বেশ কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে গেলে মিলবে ক্ষুদ্রাকার মসজিদ দুইটি। একটা থেকে অপরটির দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার। মসজিদ দুইটির বাইরের অংশ অনেকটা একই রকম। মসজিদ দুইটির ভেতরে যায়গা এতটাই কম যে, সর্বোচ্চ তিনজন মুসুল্লির বেশি একসঙ্গে নামাজ আদায় করা কঠিন। তারপুর মসজিদটির উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ্য প্রায় সমান ৮ ফুট। চুন-সুরকির মাধ্যমে কিছুটা ভাঙা জাতের ইট দিয়ে তৈরী দেয়ালের পুরত্ব হবে দেড় ফুট এবং মসজিদের দরজার উচ্চতা ৪ ফুট ও চওড়া দেড় ফুট।

মালশন গ্রামের মসজিদটির দৈর্ঘ্য, প্রস্থ্য ও উচ্চতায় তারাপুর মসজিদের চেয়ে সামান্য কিছুটা বড় হলেও কিন্তু নির্মাণ শৈলী একই ধরনের। মসজিদের দরজায় দুইটি রাজকীয় নির্দেশনা আছে। এছাড়া মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন সম্বলিত মিনার, দরজায় রাজকীয় নকশা এবং মেহরাবই মসজিদটির প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। গম্বুজের উপরে মিনার, যা অনেক আগেই ভেঙে পড়ে গেছে। দরজার খিলান, ভেতরের মিম্বার ও বাহিরের মেহরাবই বলে দেয় যে স্থাপনা দুইটি মসজিদ। প্রায় ৩ থেকে সাড়ে ৩শ বছর আগের কথা। মসজিদ তৈরী কারকরা সিদ্ধান্ত নেন, এক গুম্বুজ বিশিষ্ট এমন একটি মসজিদ তৈরি হবে যার আকৃতি হবে খুবই ছোট। মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন মুসুল্লি সেখানে নামাজ আদায় করতে পারবেন। মসজিদে একটি মাত্র ছোট্ট দরজা থাকলেও থাকবে না কোনো জানালা।

জনশ্রুতি রয়েছে, তারাসুন্দরী নামের একজন নারীর নামানুসারেই গ্রামের নামকরন করা হয় তারাপুর। তবে তারা সুন্দরী কে, বা কীভাবে তিনি এই গ্রামে এসেছিলেন সে সম্পর্কে তেমন একটা কিছু জানা যায়নি। কিন্তু তারাপুর দক্ষিণ পাড়ায় এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে সেই মসজিদটি। এটিকে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম মসজিদ বলে দাবি করছেন বিভিন্ন পর্যায়ের দর্শনার্থীরা।

স্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে এখানে নামাজ পড়া হতো। এরপর সংস্কার ও পরিচ্ছন্ন সংক্রান্ত জটিলতায় দীর্ঘদিন থেকে এই মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ রয়েছে।
তবে কে বা কারা এবং কেন এই মসজিদ নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে এখানকার গ্রামসীর মধ্যে যথেষ্ট মত পার্থক্য দেখা গেছে। যেহেতু এই মসজিদ নির্মাণের কারণ ও তা ব্যবহারে কোনো লিখিত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি সেহেতু মসজিদ সম্পর্কে যে দু’-চারটে কথিত ইতিহাস রয়েছে, এর মাঝেই হয়তোবা লুকিয়ে আছে প্রকৃত সঠিক ইতিহাস।

এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার বয়স্ক, যুবক, কিশোর সবার মধ্যেই মসজিদের ইতিহাস জানার ব্যাপক কৌতুহূল রয়েছে।

গ্রামের আজমুল হুদা রিপন জানান, ছোট বেলা থেকেই তারা এই মসজিদটিকে এভাবেই দেখে আসছেন। তার দাদার কাছে গল্প শুনে যেটুকু জেনেছেন, তা হলো- কোনো এক কারণে শিতন নামের একজন মুসলমানকে গ্রামবাসী এক ঘরে করে দিলে তিনিই একা নামাজ পড়ার জন্য এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।
তারাপুর গ্রামের আরিফুল ইসলাম জনি বলেন, সান্তাহার শহরের পাশে ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়ন সদরে ছিল নাটোরের রাজা রামাকান্তের স্ত্রী রানী ভবানীর বাবার বাড়ি। সান্তাহারসহ আশপাশ অঞ্চল তথা তারাপুরও ছিল রানী ভবানীর স্বামীর এবং পরবর্তীতে রাণী ভবানীর রাজত্বের অংশ। এরই অংশ হিসাবে রানীর আসা যাওয়া ছিলো ঐ গ্রামে।

সে সময় গ্রামে একজন পরহেজগার মুসলমান নারী ছিলেন, যিনি নিয়মিত নামাজ আদায়সহ আল্লাহর দেয়া যাবতীয় বিধি-বিধান মেনে চলতেন। তৎকালীন সময়ে এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ার কারণে ধর্মভীরু ঐ নারীর নামাজ পড়ার অনেক অসুবিধা হতো। একথা জানতে পেরে রানী ভবানী নিজেই গ্রামে এসে তার অধীনস্থ পেয়াদাদের হুকুম দেন ঐ নারীকে যেন আর কেউ নামাজ পড়তে বাঁধা না দেয় এবং নির্দেশ দেন ধর্মভীরু ঐ মুসলমান নারীর জন্য রাজকীয় নকশায় একটি মসজিদ তৈরি করে দেবার।

হয়তো এভাবেই তখন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি।

আরিফুল ইসলাম জনির এ তথ্যকে সমর্থন করেন বিরানব্বই বছর বয়স্ক বাসিন্দা শ্রী শ্যামাচরন এবং মালশন গ্রামের বিরাশি বছর বয়স্ক আজিজার রহমান মণ্ডল।

বগুড়া মহাস্থান যাদুঘরের কাষ্টডিয়ান মজিবর রহমান জানান, এ বিষয়ে তার কিছুই জানা নেই। তবে সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে হয়ত তা খতিয়ে দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ তাকে নির্দেশ দেবেন। তবে এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা।

তবে ইতিহাস যাই বলুক, দ্রুত মসজিদ দুইটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা না হলে মুসলিম এই স্থাপত্যটি যে একদিন হারিয়ে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না বলেও জানান তিনি।



মন্তব্য চালু নেই