দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা!

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ এখনও অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে এসব রোহিঙ্গা। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের পর তারা কক্সবাজারে বা সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় না থেকে দেশের অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ছে।খবর বাংলাট্রিবিউনের।

জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে দুটি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে রয়েছে ৩২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা। এ দুটি শরণার্থী শিবিরের কাছেই রয়েছে আরও দুটি অনিবন্ধিত ক্যাম্প (রোহিঙ্গা বস্তি)। যেখানে রয়েছে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এছাড়াও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে বলে দাবি করছেন এনজিও কর্মীরা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হেল্প কক্সবাজারের নির্বাহী পরিচালক আবু কাশেম বলেন, ‘কক্সবাজারে প্রায় সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অবশ্য এর কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তার ওপর জাতিসংঘের মতে ২২ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে কক্সবাজারে অনুপ্রবেশ করেছে।’

দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবাধে চলাফেরা করছে। এখন নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে, তারাও মিশে যাচ্ছে বাংলাদেশিদের সঙ্গে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের ভাষা, পোষাক, চলাফেরা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিল থাকায় তাদের মিশতে মোটেও সমস্যা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর প্রথমে উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। দু-একদিন সেখানে অবস্থানের পর সুযোগ বুঝে কৌশলে চলে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্প থেকে সপরিবারে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে।

এ বিষয়ে উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝি আব্দুল হাফিজ জানান, ‘গত এক সপ্তাহে নতুন করে আসা ১৫ থেকে ২০টি পরিবার কোথায় যেন চলে গেছে। যারা ১০ দিন আগে এই ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল, এখন তাদের কোনও হদিস নেই।’ এজন্য অভাব অনটনকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘এই রোহিঙ্গারা আর কত দিন না খেয়ে থাকবে? হয়তো কাজের সন্ধানে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গেছে। শুধু কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প নয়, টেকনাফ নয়াপাড়া ও লেদা ক্যাম্প থেকেও পালিয়ে গেছে আশ্রয় নেওয়া শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবার।’

এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরাম (এইচআরডিএফ) এর কক্সবাজারের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট অরূপ বড়ুয়া তপু বলেন, ‘সম্প্রতি মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে নতুন করে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। তারা শুরুতে অনিবন্ধিত ক্যাম্পে অবস্থান নিলেও এরপর ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন এলাকায়। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি জেলার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে বিশেষ করে কক্সবাজারে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।’

উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী বলেন, ‘এমনিতেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলায় অবস্থান করছে। এখন নতুন করে আরও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাই তাদের নিয়ে এখনই কোনও একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।’

কক্সবাজার জেলা মানবপাচার বিরোধী টাস্কফোর্সের সদস্য দিদারুল আলম রাশেদ বলেন, ‘অনেক রোহিঙ্গা আসছে যাদের গণনা করা হয়নি। আর যাদের গণনা করা হচ্ছে তারা কোথায়? তারা তো আমাদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বড় ক্ষতি। আমাদের সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে খবর রয়েছে, রাতের অন্ধকারে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বনভূমি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে।’

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের সমাজে মিশে যেতে দেওয়া যাবে না। সরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তাদের কোনও নির্দিষ্ট স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। একইসঙ্গে তাদের একটি তালিকা তৈরি করে রাখা উচিৎ যাতে পরবর্তীতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ হয়। রোহিঙ্গারা সমাজে মিশে গেলে নানা অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুযায়ী দেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। বিশেষ করে এসব রোহিঙ্গা এখন যে ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে, সেখান থেকে যাতে কোথাও যেতে না পারে সেজন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’

এদিকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় নতুন করে ২১ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) অফিস প্রধান সানজুক্তা সাহানি গত সপ্তাহে জানান। অবশ্য, আইওএম’র পরিসংখ্যান উড়িয়ে দিয়ে এক সপ্তাহে আগে জাতিসংঘ ২২ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলেছে।

উল্লেখ্য, গত ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে সীমান্ত পুলিশের ৯ সদস্য নিহত হয়। সেই হামলার জন্য রোহিঙ্গা মুসলমানদের দায়ী করে আসছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। এরপর থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।



মন্তব্য চালু নেই