দুর্গম পাহাড়ে লুকাতে চায় জঙ্গিরা!

গভীর অরণ্যের নিঝুম পাহাড়ে ২২ আগস্ট রাত আনুমানিক ১১টার দিকে কথা হচ্ছিল বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার রনিনপাড়া গ্রামের জনসন বমের সঙ্গে। জনসন রনিনপাড়া গ্রাম সমাজের সভাপতি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের রনিনপাড়ার কাছাকাছি ওই জায়াগাটিতে যাওয়ার আগে টানা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল আর গিরিতে চলা পথে কোনো জনমানুষের দেখা মেলেনি। এ ৫ ঘণ্টার পুরো পথেই কখনো পাহাড়ি ঝিরি কখনো ঢালু সরু পথ। সেই মাঝরাতে আকাশের তারা, থেকে থেকে জোনাকির আলো আর চারদিকে সূচালো শুঙ্গের মশার কামড় খেতে খেতে জনসন জানান, এখন আর পারতপক্ষে এদিকে বাঙালিরা আসে না। আগেও খুব একটা আসত না। এখানকার বাসিন্দারাও এতো রাতে চলাচল করে না। বাঙালিতো পরের কথা।খবর পরিবর্তনের।

কেন বাঙালিরা আসে না জানতে চাইলে জনসনের সাফ জবাব, বাঙালি দেখলেই সবাই এখন জঙ্গি বলে সন্দেহ করে। আবার কিছু জঙ্গি পাহাড়ের দিকে আশ্রয় নিচ্ছে বলেও শোনা যায়। জঙ্গিদের ভয়ে সাধারণ টুরিস্টদেরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদিকে আসতে দেয় না।

জনসনের সঙ্গে কথার সূত্র ধরে শুরু হয় অনুসন্ধান আর জিজ্ঞাসা। অস্থির পাহাড়ি অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতার খোঁজে নামে একটি নিউজ পোর্টাল।

এর চারদিন পর ২৬ আগস্ট রনিনপাড়ার জনসনের কথার রেশ ধরে চলা অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বান্দরবানের থানচির দুর্গম রেমাক্রী টুরিস্ট এলাকায় কথা হয় ঢাকা থেকে যাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে। এ চারজন টানা ১০ দিন ধরে ঘুরেছেন গহীন পাহাড়ি এলাকায়। বান্দরবানের চিম্বুক রেঞ্জ থেকে আলুটিলা আলিকদম হয়ে মাতামুহুরি সাঙ্গু পেরিয়ে তারা তখন অবস্থান করছিলেন রেমাক্রীতে। পরিবর্তনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানালেন, এ দুর্গম পথে প্রতি পদে পদে পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। প্রতিবারই লম্বা সময় পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে, তারা জঙ্গি নন। এ চার ছাত্রছাত্রী তাদের ১০ দিনের সফরের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে জানান, স্থানীয় বাসিন্দা ও বাঙালি সবাই তটস্থ ওইসব এলাকায় জঙ্গি অনুপ্রবেশের ভয়ে। জঙ্গি আশঙ্কায় এ চার শিক্ষার্থী প্রতিরাতে ছুরি সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতেন বলেও জানান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, তীব্র জঙ্গিবিরোধী অভিযানের মুখে সমতলে তাড়া খেয়ে গহীন পাহাড়ে আশ্রয় নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে উগ্র ইসলামপন্থী জঙ্গিরা। শুধু আশ্র্রয় নয়, পাহাড়ি এলাকায় ‘সেটেলার’ বলে পরিচিত সরকারবিরোধী বাঙালি কিছু অংশ, ইতোমধ্যে পাহাড়ে বসবাস করা বিপথগামী বাঙালি, সুবিধা ও অধিকার বঞ্চিত স্থানীয় বিভিন্ন গ্রুপ, সীমান্তের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আঁতাত করে অস্ত্র সংগ্রহেরও চেষ্টা চালাচ্ছে।

সমতলে ধারাবাহিক জঙ্গি হামলার পর চলা জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানে এরইমধ্যে নিহত বা গ্রেফতার হয়েছে একাধিক জঙ্গি নেতা। ফলে কিছুটা কোণঠাসা জঙ্গি সদস্যরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভেবে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিতে চাইছে। পাহাড়ে এখনও এমন এলাকা আছে যেখানে রাতের বেলাতো বটেই, দিনেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রবেশ প্রায় অসম্ভব।

এ পরিস্থিতিতে বান্দরবানের বেশ কিছু এলাকায় জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কায় পুলিশ-বিজিবি তাদের নজরদারি ও টহল বাড়িয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবানের পুলিশ সুপার (এসপি) সঞ্জিত কুমার রায় বলেন, ‘জঙ্গিরা পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় খুঁজতে পারে বা তৎপরতা চালাতে পারে এমন একটি মেসেজ ঢাকা থেকে আমাদের কাছে এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো কিছু চিহ্নিত করতে পারিনি।’

সঞ্জিত কুমার রায় বলেন, ‘আমরা অনুসন্ধান করছি। অনুসন্ধানে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।’

সূত্র জানায়, বিচ্ছন্নতাবাদীদের পাশাপাশি জঙ্গি তৎপরতার সম্ভাব্য এলাকা হিসেবে সবচেয়ে বেশি নজরদারিতে আছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, রুমা ও থানচি এবং রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি এলাকা। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় সীমানায় অবস্থি রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি।

নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় মায়ানমারের রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আধিপত্য এখনও অনেকটাই রোহিঙ্গা ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর রয়ে গেছে। মিয়ানমারের রাখাইন স্টেট বলে পরিচিত অংশের বিলুপ্ত বা আত্মসমর্পণ করা সংগঠন আরএস, এআরএনও, আইআরআইএন এর যে সব গেরিলা সদস্য ছিলেন তাদের কেউ কেউ এখন দেশের ভেতরের মুসলিম উগ্রপন্থী জঙ্গিদের সহায়তা, ট্রেনিং এমনকি অস্ত্র যোগানের চেষ্টা করছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

থানচিতে আরাকান আর্মির তৎপরতা সম্প্রতি বেড়ে যাওয়ায় ওই এলাকায় যাতে ‘ইকুয়াল ইন্টারেস্টে’ দেশীয় জঙ্গি ও আরাকান আর্মি এক না হতে পারে সে জন্যও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে থানচিতে গুটি কয়েক বাঙালির বাইরে প্রায় সব জনগোষ্ঠীই আদি বাসিন্দা হওয়াতে মুসলিম জঙ্গিরা খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ধারণা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে থানচি এলাকায় র্দীঘ দিন দায়িত্ব পালন করা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৩৩ ব্যাটালিয়নের সদ্য বিদায়ী কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বাস্তবতা হল থানচি এলাকায় কোনো সন্ত্রাসীর সঙ্গে দেশের ভেতরের জঙ্গিদের যোগাযোগ হওয়া সম্ভব না। বাঙালি যারা আছেন তাদের সাথে যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যদিও বাঙালি আছে হাতেগোনা কয়েকজন। যারা আমাদের আওতার মধ্যে থাকে। তারপরও আমরা কোনো সম্ভাবনা উড়িয়ে দেই না।’

তিনি আরও জানান, যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্প্রতি থানচি এলাকায় বিজিবি টহল বাড়ানো হয়েছে।

রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি স্থানীয়দের কাছে সব সময়ই অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের একটি কুখ্যাত রুট। যদিও বিলাইছড়ি থেকে বান্দরবানে সহজে রুমা হয়ে আসা যায়। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছ থেকে বাংলাদেশের ভেতরে অস্ত্র আনার জন্য বিলাইছড়ি-আলিকদম-বান্দরবান রুটটি অতীতে ব্যবহারের বেশ কিছু নজির রয়েছে। এখনো এ রুটে অস্ত্র আনার চেষ্টা চলছে বলেও গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে নদীপথে যাতে দেশের ভেতরের জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র কেউ পৌঁছাতে না পারে এ বিষয়ে বান্দরবান পুলিশ প্রশাসন তৎপর রয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, জঙ্গিগোষ্ঠী জেএমবির সঙ্গে সীমান্তে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনের (আরএসও) অনেক পুরানো সর্ম্পক রয়েছে। আরএসও নিস্তেজ হয়ে গেলেও তাদের অনুসারীদের সাথে জেএমবির একটি অংশ এখনও সুসর্ম্পক রেখে যাচ্ছে।

পার্বত্য তিন জেলায় উল্লেখযোগ্য অতীত জঙ্গি তৎপরতা
২০০৭ এর ১৭ আগস্ট একযোগে দেশের ৬৩ জেলায় জেএমবির বোমা হামালার অংশ হিসেবে কেবল রাঙ্গামাটি জেলা ছাড়া বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতেও হামলা হয়েছিল। এর বাইরে কোনো জঙ্গি হামলার নজির না থাকলেও বিশেষত বান্দরবান থেকে একাধিকবার জঙ্গিদের ব্যবহার করার মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র ও একাধিক প্রথম সারির জঙ্গি নেতা আটকের ঘটনা ঘটেছিল।

২০০৪ সালে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার শান্তিপুর থেকে প্রশিক্ষণের সময় র‌্যাব জেএমবির সক্রিয় চার সদস্যকে আটক করে। যাদের মধ্যে জেএমবির চট্টগ্রাম জেলার সেকেন্ড ইন কমান্ড আব্দুর রহিম ছিলেন।

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে বান্দরবান থেকে জঙ্গিদের ব্যবহারের জন্য আনা একে-২২ রাইফেল উদ্ধার হয়। এর বাইরে চট্টগ্রাম থেকে জেএমবির সক্রিয় তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একজন প্রশিক্ষক আছেন, যার বাড়ি বান্দরবানে।

এ ছাড়া জেএমবি আত্মপ্রকাশের পর থেকে তৎকালীন বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা মুসলিম উগ্রপন্থী নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে গভীর সখ্য রেখে চলছিল। সে সব রোহিঙ্গা সংগঠনের গেরিলারা জেএমবির প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করত। তাদের বেশ কিছু প্রশিক্ষণ শিবিরও পরবর্তীতে পুলিশ র‌্যাবের অভিযানে ধ্বংস হয়।



মন্তব্য চালু নেই