দুদকের মামলার গ্যারাকলে জিয়া পরিবার

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পরিবার এবং ১৯ দলীয় জোটের কেন্দ্রিয় পর্যায়ের ৩ শতাধিক নেতা দুদকের করা মামলার গ্যারাকলে আটকা পড়েছে। এরমধ্যে কেন্দ্রিয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও এমপি এবং জেলা পর্যায়ের নেতাও রয়েছেন। এই সব মামলা এবং অভিযোগ থেকে সহসা রেহাই পাচ্ছেন না নেতারা।

জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে রয়েছে দুদকের ২৫ মামলা। বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৫ মামলা, তারেকের ১৪, কোকোর ৫ এবং তারেকের স্ত্রী ডা. জোবায়দার বিরুদ্ধে ১ মামলা রয়েছে।

এতোদিন এইসব মামলার বিচারিক কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে মামলা স্থগিত ছিল। কিন্তু গত ৭ মে হুটকরে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের ২ মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু করে সরকার। আর ঢাকার বকশিবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের অস্থায়ী আদালত স্থাপন করেছে সরকার।

জানা যায়, গত ১৯ মার্চ ঢাকার তৃতীয় ও বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়ের আদালত শুননি শেষে দুদকের এই ২ মামলায় খালেদা এবং তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। একই সঙ্গে বিচারিক আদালতে আগামী ২১ মে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন।

এইমলার অপর আসামিরা হলেন বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরুল ইসলাম খান, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল (ইকোনো কামাল), ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী।

জানা যায়, ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ কেলেংকারির অভিযোগে দুদক রমনা থানায় মামলা করে। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট দুদকের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ তদন্ত শেষে বেগম জিয়া, তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধের আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।

গত ২০১১ সালের ৮ আগস্ট দুদকের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ খান বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের জমি ক্রয়ের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগে বেগমা জিয়াসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি এই মামলায় বেগম জিয়াসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন দুদক তদন্তকারী ওই কর্মকর্তা।

২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৫ মামলা করা হয়। অর্থ পাচার মামলায় কোকোর ৬ বছরের কারাদন্ড ঘোষণা হয়।

খালেদার মামলা : কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের গ্যাটকোকে ঠিকাদার নিয়োগে রাষ্ট্রের ১ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে কোকোসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বেগম জিয়া ও তারেকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালে ৫ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলাটি করে দুদক।

বড়পুকুড়িয়া কয়লাখনির ঠিকাদারি কাজে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় বেগম জিয়াসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

নাইকো রিসোর্স কোম্পানিকে অবৈধভাবে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলা করে দুদক।

তারেকের মামলা : সিঙ্গাপুরে প্রায় ২১ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট থানায় তারেক রহমান ও তার বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।২০১০ সালের ৬ জুলাই আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুদক। এই মামলায় বিচারিক আদালত তারেক রহমানে খালাস দেয়। কিন্তু উচ্চ আদালত আবার ওই মামলায় তারেককে অভিযুক্ত করার নির্দেশ দেয়। বর্তমানে এই মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কাফরুল থানায় তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

এছাড়া আয়কর ফাঁকি : বিভিন্ন কর বর্ষে ২৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকা আয়কর ফাঁকির অভিযোগ এনে ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট মামলাটি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা : বিস্ফোরক ও হত্যার অভিযোগে পৃথক দুটি মামলায় তারেক রহমানকে আসামি করা হয়। মামলা দুটি ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে স্থাপিত অস্থায়ী বিশেষ আদালতে বিচারাধীন।

এক কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে ২০০৭ সালের ৮ মার্চ গুলশান থানায় দ্রুত বিচার আইনে তারেক রহমান, তার এপিএস মিয়া নুরুদ্দিন অপু এবং, ঠিকাদার আমিন আহমেদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে মামলাটি করে দুদক। পরে একই বছর ১৮ মার্চ তদন্ত শেষে পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করে।

৮০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৭ মার্চ গুলশান থানায় মামলা করেন জনৈক খান মো. আফতাব উদ্দিন। একই বছরের ২৭ মে ৪ কোটি ৮৯ লাখ চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলা করেন আবু সাঈদ সোহেল। ওই থানায় ২০০৭ সালের মার্চে হারুন ফেরদৌস এবং ১৩ মে সৈয়দ শাহেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। একই বছর ১৪ এপ্রিল শাহবাগ থানায় মামলা করেন খায়রুল বাশার।

২০০৭ সালের মার্চে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করার অভিযোগে দ্রুত বিচার আইনে, মার্চে মাসে কোম্পানি আইন ভঙ্গ ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে গুলশান থানায় পৃথক ৩ মামলা করে পুলিশ। চাঁদাবাজি ও ঘুষ গ্রহণের কয়েকটি মামলায় তারেকের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সহযোগী আসামি করা হয়।

কোকোর মামলা : অর্থ পাচার- ৯ লাখ ৩২ হাজার ৬৭২ মার্কিন ডলার এবং ২৮ লাখ ৮৪ হাজার ৬০৪ সিঙ্গাপুর ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৩ কোটি টাকা) পাচারের অভিযোগে ২০০৯ সালের ১৭ মার্চ কাফরুল থানায় মামলাটি করে দুদক। এ মামলায় কোকো ছাড়াও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) আকবর হোসেনের ছেলে সায়মনকে আসামি করা হয়।

গত বছর ১২ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় চলতি বছর ২৩ জুন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত কোকোকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেন। কোকোর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগে গুলশান থানায় ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ ও ১৬ মে পৃথক ২ মামলা হয়।

কোকোর বিরুদ্ধে ২ কোটি ৪ লাখ ৬১ হাজার ২০৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ১১ লাখ ২০ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৩ এপ্রিল রমনা থানায় মামলা করে দুদক। মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

কোকোর বিরুদ্ধে ২৪ লাখ ৩৯ হাজার ২২৬ টাকার কর ফাঁকির অভিযোগে মামলাটি করে এনবিআর।

আরো জানা যায়, সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার,সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, সাবেক মন্ত্রী মির্জা আবাবাস, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জিয়াউল জিয়া, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির, সাবেক উপ মন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস দুলু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আনম এহসানুল হক মিলন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান, ইসলামি ঐক্য জোটের নেতা মুফতি ইজাহারুল ইসলাম, জামায়াতের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী, সাবেক এমপি গোলাম পরোয়ারসহ ৩ শতাধিক নেতার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা দায়ের এবং অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের নামে হয়রানীর অভিযোগ আনেন বিএনপি নেতারা।

এই বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে করা প্রতিটি মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা কোনো মামলাই আইনে টেকে না। ন্যায়বিচার হলে সব মামলায় জিয়া পরিবারের সবাই খালাস পাবেন।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে বিচার বিভাগেও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। আদালতের ওপর আমাদের আস্থা রয়েছে। আশা করি আমরা ন্যায়বিচার পাব। ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া আরো বলেন, বর্তমান জনবিচ্ছিন্ন সরকার বিএনপি নেতৃত্ত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের নেতা কর্মীদের দুদক এবং পুলিশ দিয়ে হয়রানী করছে।

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের পর তৎকালীন গুরুতর অপরাধ দমন জাতীয় সমন্বয় কমিটির (এনসিসি) করা শীর্ষ দুর্নীতিবাজের তালিকায় তারেক রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই বছর ৭ মার্চ তাকে গ্রেফতার করে যৌথ বাহিনী। অসুস্থতার কারণে ২০০৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্যারোলে মুক্তি পেয়ে সপরিবারে লন্ডন চলে যান তারেক। সরকার তার প্যারোল বাতিল করলেও তিনি লন্ডনেই চিকিৎসাধীন আছেন।



মন্তব্য চালু নেই