দুই যুগেও হলো না ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’

নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় দুই যুগ পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে পালা করে দুই বড় রাজনৈতিক দল দেশ পরিচালনা করলেও আজও ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামকে। সরকারি ও রাজনৈতিক সভায় মৌখিকভাবে একে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় বটে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক কিংবা দাপ্তরিকভাবে তার কোনো স্বীকৃতি নেই।

পলোগ্রাউন্ড থেকে আউটার স্টেডিয়াম, কলেজিয়েট থেকে চট্টগ্রাম কলেজ মাঠ- সবখানে একাধিক জনসভায় চট্টগ্রামকে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ করার আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ মেয়াদে দুই দফা ক্ষমতায় থেকেও সেই আশ্বাসবাণী বাস্তবায়ন করা হয়নি।

আর ১৯৯৬-২০০১ ও ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত তিন দফায় ক্ষমতাসীন থেকেও চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করেননি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ফলে দুই যুগেও পূর্ণতা পায়নি চট্টগ্রামবাসীর বাণিজ্যিক রাজধানীর স্বপ্ন।

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ১৯৯২ সালে প্রথম দাবি তুলেছিল বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামকে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ ঘোষণার। এই দাবিকে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে আন্দোলনে পরিণত করেছিল চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ। তখন চট্টগ্রামের প্রতিটি মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয় চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার দাবিটি।

চট্টগ্রামবাসীর দাবির মুখে ২০০২ সালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক জনসভায় চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে মৌখিকভাবে ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়নে কোনোরকম অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হলো চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ সমুদ্রবন্দর। তাই অধিকাংশ শিল্পকারখানাও গড়ে উঠেছে এখানে। কিন্তু বাণিজ্যিক রাজধানী না হওয়ায় এসব শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মূল কার্যালয় রয়ে গেছে রাজধানীতেই, যা দেশের অর্থনীতির জন্য প্রতিকূল।

মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হলে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামেই করতে হতো। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসত। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার জন্য চট্টগ্রাম চেম্বার দাবি তোলার পর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ এই দাবিকে জোরালো করে। এই দাবিতে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন ও বর্তমান সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সভা-সমাবেশ করেছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালে খালেদা জিয়া এক জনসভায় চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগ একবারের জন্যও আর মাঠে নামেনি।

এ প্রসঙ্গে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু ২০০২ সালে খালেদা জিয়ার ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত তা আর গড়ে ওঠেনি।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর ধরপাকড় আর দমন-পীড়নে এ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলারা এই উদ্যোগটিকে জটিল পর্যায়ে নিয়ে যায়।

এক প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। চট্টগ্রামেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। শনিবার বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে আসছেন। আমি মনে করি চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ।”

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য আমরা এগোব। তবে যে কাজ দুই যুগে হয়নি, তা হঠাৎ করে তো আর সম্ভব নয়। তবে আমি মনে করি, সময় এসেছে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবির বিষয়টি তুলে ধরব।”

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি সাংসদ এম এ লতিফ বলেন, “নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার দাবির প্রতি তৎকালীন বিএনপির সরকারের হটকারিতা দেখে ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। পরে ২০০১ সালে আবার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের জন্য জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে বিএনপি সরকার। এই সহযোগিতা না পেলে হয়তো বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা কঠিন হতো।”

এম এ লতিফ বলেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলা একসময় স্বপ্নের মতো ছিল। আজ এটি বাস্তব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল শনিবার বিকেলে উদ্বোধন করবেন এই বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র। এই কেন্দ্রই পথ দেখাবে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলার।” তবে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র উদ্বোধনের সময় বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।



মন্তব্য চালু নেই