দুই বাংলাদেশির বীরত্বে রক্ষা পেল আমিরাতির প্রাণ
আমরা যা করেছি তা বাহাদুরি না, স্রেফ মানবিক দায়িত্ব পালন করেছি। কথাগুলো আরব আমিরাত প্রবাসী আবু জহির (৩০) আর মোহাম্মদ শাহের (৪৪)। বাহাদুরির চেয়েও বড় কিছু করে দুই বাংলাদেশি এভাবেই বিনয়ী বক্তব্য রাখেন দেশটির মিডিয়ার কাছে।
আমিরাতের উত্তরাঞ্চলের রাস আল খাইমার খোর এলাকায় রাতের অন্ধকারে জলাশয়ে ডুবে মরতে থাকা এক আমিরাতিকে উদ্ধার করেন তারা। ওই ব্যক্তি তার ল্যান্ডক্রুজার গাড়িসহ পানিতে পড়ে যান। এসময় কাছেই এক দোকানে বসে চা পান করছিলেন বাংলাদেশি আবু জহির ও মোহাম্মদ শাহ। এই কাজ করতে গিয়ে তাদের নিজের জীবন সংশয়ও দেখা দিতে পারতো।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে স্থানীয় এমারাত আল ইউম পত্রিকাকে মোহাম্মদ শাহ বলেন, “যখন আমরা দেখি গাড়িটি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে কালবিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ি পানিতে। তারপর সাঁতরে এগিয়ে যাই ডুবন্ত গাড়িটির দিকে। এসময় গাড়ির ভেতর থেকে সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে এর চালক চিৎকার করছিলেন। তিনি ভেতর থেকে দরোজা খুলতে পারছিলেন না অপরদিকে পানিতে গাড়ি ভরে যাচ্ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “চালক গাড়ির জানালার কাঁচও ভাঙতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি…আমিও জানালার কাঁচ ভাঙার চেষ্টা করি কিন্তু পারিনি। এরপর আমি ও আমার সঙ্গে থাকা বন্ধু দুজনে টেনে দরোজাটা খুলে ফেলি। আমরা ড্রাইভারকে টেনে বের করে আনি এবং সাঁতরে পানির ওপরের দিকে আসতে থাকি। উদ্ধার পাওয়া ব্যক্তি চেহারায় আঘাত পেয়েছিল। একপর্যায়ে আতঙ্কে সে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। আমরা তাকে বলি, শান্ত থাকতে- যাতে তাকে সহজে উদ্ধার করা যায়।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই বাংলাদেশি তাকে তীরে নিয়ে আসেন এবং পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেন। অ্যাম্বুলেন্স এসে লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
রাতের অন্ধকারে কীভাবে তারা ওই সাহসী কাজ করলেন- সাংবাদিকদের এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে শাহ বলেন, “আপনারা যেমন বলছেন, তা আসলে তেমন বীরত্বসূচক কোনও কাজ নয়, এটা স্রেফ একটি মানবিক দায়িত্ব, যা আমরা পালন করেছি… আমরা সত্যি আনন্দিত যে একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পেরেছি।”
তবে আমিরাতি মিডিয়া উদ্ধার পাওয়া ব্যক্তির নাম-পরিচয় কিছুই জানায়নি।
এ ঘটনা স্থানীয় বাংলাদেশিদের বেশ গৌরবের অনুভূতি এনে দিয়েছে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শুক্রবার সংবাদটির শিরোনামে আমিরাতি পত্রিকা এমিরেটস২৪/৭ উল্লেখ করেছে, ‘টু এশিয়ানস সেভ লাইফ অব আমিরাতি আফটার কার প্লাঞ্জড ইন আরএকে ওয়াটার’ এখানে তারা বাংলাদেশি পরিচয়টি ব্যবহার না করে পুরো একটা মহাদেশকে তুলে ধরেছে। অথচ কোনো ছোটখাটো অপরাধের ঘটনায় যখন কোনো বাংলাদেশির নাম পাওয়া যায়- তখন তারা সেটাকে ফলাও করে বাংলাদেশের নামসহ শিরোনামে তুলে ধরে।
এ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের চ্যাম্পিয়ন হেলথ ক্লাব অ্যান্ড স্পোর্টস গ্রুপে কর্মরত অপারেশন টিম লিডার মিজান রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে নিউজবাংলাদেশকে বলেন, “মিডল ইস্টের মিডিয়াগুলো সাধারণত ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রভাবিত। এদের ওপরের স্তরের অনেক কর্মী ওই দুটি দেশের। এরা সাধরণত বাংলাদেশিদের ভালো কিছু প্রচার করতে চায় না। যতটা নেতিবাচকভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরা যায়- সেই চিন্তায় থাকে তারা। এজন্য অবশ্য আমাদের অ্যাম্বেসি তথা সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সেসব দেশের মিডিয়ায় নিয়োগের ব্যবস্থা করলে ধীরে ধীরে এ অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে করি।”
সুফিয়ার আত্মত্যাগ: এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে আবু ধাবির সমুদ্র সৈকতে ডুবন্ত চার শিশুকে প্রাণে বাঁচানো বাংলাদেশি গৃহকর্মী সাফিয়া প্রাণ বিসর্জন দেন। পরে তাকে মরণোত্তর সম্মান জানায় দুবাই টিভি। মারা যাওয়ার আগে সাফিয়ার উদ্ধার করা ওই চার শিশু ও তাদের অভিভবাকদের অনুষ্ঠানটিতে নিয়ে আসা হয়। আরব আমিরাত প্রবাসী সাফিয়া মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই চার শিশুর একজনের পরিবারে গৃহকর্মীর দায়িত্ব পালন করছিলেন।
প্রসঙ্গত, আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিদেশি গৃহপরিচারিকাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের পাশাপাশি মনিব পরিবারের বিরুদ্ধে গৃহকর্মীদের করা হত্যাসহ নানান অপরাধের কাহিনি খুবই পরিচিত। মধ্যপ্রাচ্যের মিডিয়ায় এ ধরনের খবরও দেখা যায় যে, গৃহকর্মীরা মনিবের পরিবারের ওপর কালোজাদুচর্চাও করছে। তবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিশুগুলো বয়ান করে, সাফিয়া তাদের চিৎকার শুনে কীভাবে পাগলের মতো ছুটে গিয়ে তাদের ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন।
শেষ শিশুটিকে স্বজনদের হাতে তুলে দিয়েই নিস্তেজ হয়ে পড়েন সাফিয়া। আবু আব্দুল্লাহ নামের এক আমিরাতি, যিনি ওই ৪ শিশুর একজন আব্দুল্লাহর পিতা, সাফিয়ার আত্মত্যাগের মহতী দৃশ্যের বয়ান দিতে গিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমি সৈকতে এসে দেখি প্রবল স্রোত এড়িয়ে সাফিয়া প্রাণপনে সাঁতরে পাড়ে আসার চেষ্টা করছেন… তিনি বারবার ডুবে যাচ্ছিলেন আবার পরক্ষণেই ভেসে উঠছিলেন। একপর্যায়ে আমরা তাকে পাড়ে টেনে তুলতে সক্ষম হই, কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স এসে পৌঁছার ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন।
“বাঙালি নারীর আত্মত্যাগে মুগ্ধ ওই আমিরাতি কৃতজ্ঞ কণ্ঠে আরও বলেন, “তিনি আমার ছেলে ও তার ৩ সঙ্গীর প্রাণ বাঁচিয়ে খুবই বীরোচিত কাজ করেছেন। এই নারীর কাছে আমরা সবাই ঋণী আর তার মৃত্যুতে শোককাতর হয়ে পড়েছি।” একটি শিশু বলে, “তিনি আমাদের একের পর এক পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন কিন্তু প্রবল ঢেউ তাকে কেড়ে নেয়!”
উপস্থাপক তার বক্তব্যে সাফিয়ার ঘটনাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পবিত্র কোরানের সুরা আর রাহমানের একটি আয়াত উদ্ধৃত করেন (‘হাল জাজাউল এহসান ইল্লাল এহসান‘ অর্থাৎ সৎকাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কী হতে পারে?) এসময় উপস্থাপক আরও বলেন, সাফিয়ার আত্মত্যাগের এই ঘটনা আরব আমিরাতে গৃহকর্মীদের বিরুদ্ধে বিরাজমান অভিযোগগুলোর বিপরীত চিত্রই উপস্থাপন করে।
মন্তব্য চালু নেই