দুই দশকে গ্রেপ্তার সাড়ে ৩ হাজার জঙ্গি!

১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি কবি শামসুর রাহমানকে নিজ বাসায় হত্যা চেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয়। গত প্রায় দুই দশকেও জঙ্গিবাদ সমূলে ধ্বংস করা যায়নি। দিন দিন যেন তা বেড়েই চলেছে।

সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়নের শিবনগরে জঙ্গি আস্তানায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হয় চার জঙ্গি, এ নিয়ে এ ধরনের হামলায় নিহত হয়েছে ৮১ জঙ্গি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জঙ্গিবাদ দমনে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন অনেকটা সক্ষম।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার পরও থেমে নেই জঙ্গি তৎপরতা। পলাতক জঙ্গিরাই সংগঠন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। তাদের মধ্যে কেউ জামিনে মুক্ত হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে, কেউ আবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ দলকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখছে, কেউ হয়ে উঠছে আগের চেয়েও দুর্র্ধর্ষ।

অনেকে আবার দেশের বাইরে গিয়ে সংগঠন পরিচালনা, অর্থায়নসহ নানাদিক থেকে ভূমিকা রাখছে। সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতরে অপরাধ পর্যালোচনা সভায় উত্থাপিত একটি প্রতিবেদনে গত ১৮ বছরে জঙ্গিবাদের উত্থান-পতনের একটি সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সারাদেশে গত ১৮ বছরে জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত ৮৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার আসামি। ১১৯টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে।

এর মধ্যে দুটি মামলায় হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নান, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ ১০ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

অপরদিকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ ও আত্মঘাতী বোমা হামলায় নারী এবং শিশুসহ নিহত হয়েছে ৮১ জন জঙ্গি।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, জঙ্গিবাদ বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কারাগারে বন্দি জঙ্গিরা জামিনে বেরিয়ে ফের জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে। কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। সেখানে থেকে জঙ্গিবাদকে অর্থায়ন করছে। জঙ্গিদের নিত্য নতুন এসব কৌশল মোকাবেলায় পুলিশও পাল্টা কৌশল তৈরি করছে।

জঙ্গিদের সার্বিক তথ্যাদি হালনাগাদ করতে দেশের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে হলি আর্টিজান ঘটনায় জামিনে থাকা আসামিদের বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য জানতে চেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে।

১৯৯৯ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ মার্চ পর্যন্ত জঙ্গি ঘটনায় মামলার সংখ্যা ৮৫০টি। তবে সর্বশেষ গত ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে মোবারকপুর ইউনিয়নের শিবনগরে জঙ্গি আস্তানায় আত্মঘাতী বোমা হামলায় আরো একটি মামলা হয়েছে।

এ নিয়ে জঙ্গি ঘটনায় মামলার সংখ্যা ৮৫১টি। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে তিন হাজার ৪৫৭ জন। এসব মামলার মধ্যে বিচার সম্পন্ন হয়েছে ১১৯টির। আর বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬১৯টি।

জঙ্গি ঘটনায় সর্বাধিক ৩৪১টি মামলা হয়েছে ডিএমপিতে, এতে আসামির সংখ্যা ৮০৬ জন। ঢাকা রেঞ্জে মামলার সংখ্যা ১০টি, আসামি ৩১১ জন। রাজশাহী রেঞ্জে মামলা ১০১টি, আসামি ৩৬৭ জন। সিআইডির মামলার সংখ্যা ১৬টি, আসামি ১৪২ জন। সিএমপি মামলার সংখ্যা ৪৪টি, আসামি ২৩৬ জন। কেএমপি মামলার সংখ্যা তিনটি, আসামি ২৮ জন। আরএমপি মামলার সংখ্যা সাতটি, আসামি ৪৫ জন।

বিএমপি মামলা ১৪, গ্রেফতার ১৭৬ জন। চট্টগ্রাম রেঞ্জ মামলা ৪৭, আসামি ২৩৪ জন। খুলনা রেঞ্জ মামলা ৪২, আসামি ১৮৬ জন। বরিশাল রেঞ্জ মামলা ১২, আসামি ৭২ জন। সিলেট রেঞ্জ মামলা ১৮, আসামি ৭১ জন। রংপুর রেঞ্জ মামলা ৩১, আসামি ২১৫ জন। রেলওয়ে রেঞ্জ মামলা সাত, আসামি ১৭ জন। ময়মনসিংহ মামলা ৪৪, আসামি ১৬৫ জন।

জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে নিহত হন দুই বিচারক সাহেল আহমেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ে। এ মামলায় আদালত ২০০৬ সালের ২৯ মে ৭ জঙ্গিকে ফাঁসির আদেশ দেয়। এদের মধ্যে ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ ছয়জন জঙ্গির মৃত্যুদ- কার্যকর হয়।

তারা হলেন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, শায়খের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন ও খালেদ সাইফুল্লাহ (ফারুক)। একই মামলার অপর আসামি জেএমবি নেতা আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৬ সালে ১৬ অক্টোবর।

অপরদিকে, ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের হজরত শাহজালাল (র.) এর মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় গত ১২ এপ্রিল ফাঁসি কার্যকর হয় শীর্ষ জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান, তার দুই সহযোগী শরীফ শাহেদুল ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনের।

এদিকে, ২০১৩ সাল থেকে গত ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ২২ জন জঙ্গি। অপরদিকে, র‌্যাব পুলিশের অভিযানের সময় গোলাগুলি ও আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় পাঁচ শিশু এবং নারীসহ ৬৯ জন।

এর মধ্যে সর্বাধিক ছিল রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত হয় ১১ জঙ্গি। এ ছাড়া জঙ্গি অভিযানের সময় জঙ্গিদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডে নিহত হন র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ সাতজন।



মন্তব্য চালু নেই