দুইশ মামলাই এখন ‘হাতিয়ার’!

গত তিন বছর দেশজুড়ে সহিংসতা ও নাশকতায় ১০ সহশ্রাধিক মামলার আসামি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। এগুলোর মধ্যে দুই শতাধিক তদন্তকাজ দীর্ঘ দিন ধরেই স্থবির আছে। সরকারবিরোধী কর্মসূচির সময় এসব পুরনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের। তবে সম্প্রতি সরকারের হাইকমান্ড পুলিশ সদর দপ্তরকে নাশকতার মামলাগুলোর তদন্তকাজ শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানায়।

পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, গত তিন বছর ধরে বিএনপি-জামায়াত জোট হরতাল-অবরোধের নামে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, রাস্তাঘাট ভাঙচুর, গাছ উৎপাটন, পুলিশের উপর হামলা, অস্ত্র লুট, থানা ও ফাঁড়িতে হামলা, যানবাহনে আগুন ধরিয়ে নিরাপরাধ মানুষ হত্যা ও আহত করেছে। এসব ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে ১০ সহস্রাধিক মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের শীর্ষ পর্যায়ের সহস্রাধিক নেতাসহ তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের। বেশির ভাগ মামলার বাদি পুলিশ। বিএনপিসহ ২০ দলের শীর্ষ নেতাদের আসামি করায় উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা এবং স্বাক্ষী না পাওয়ায় তদন্তে সময় লাগছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কিছু কিছু মামলা আছে যার স্বাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। যে কোনো মামলার চার্জশিট দিতে হলে পর্যপ্ত পরিমাণ স্বাক্ষী লাগে। তাড়াহুড়া করে মামলার চার্জশিট দিয়ে দিলে বিচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র লাভবান হবে না। হেরে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। যেসব মামলা এখনো ফাইলবন্দি অবস্থায় আছে তা নিয়ে সম্প্রতি পুলিশ হেডকোয়ার্টাসে একটি বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠক থেকে সবকটি রেঞ্চের ডিআইজি ও ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। কারণ যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন তারা এসব মামলার এজাহারনামীয় আসামি।’

আরেক পুলিশ কর্মকর্তা অবশ্য বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লাভবান হতে ইচ্ছে করে অনেক মামলার তদন্ত জিইয়ে রাখা হয়। মাঝে মধ্যে সরকার বলে দেয়, মামলার তদন্ত দ্রুত শেষ করতে। এই ক্ষেত্রে পুলিশ পড়ে যায় বিপাকে।’

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ, সেক্রেটারি জেনারেল ডাক্তার শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় শতাধিক মামলা রয়েছে। ওইসব মামলার অর্ধেকেরও চার্জশিট দেয়া হয়নি। তাছাড়া জামায়াতের ঢাকা মহানগর আমির মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে সারাদেশে দুইশ মামলা রয়েছে। বেশিরভাগ মামলার তদন্তই হিমঘরে আটকে আছে।’ জামায়াতের আরেক নেতা সাবেক সাংসদ হামিদুর রহমান আযাদসহ একাধিক নেতার মামলার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। বিএনপি নেতাদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বলে তিনি জানান।

সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল খিলগাঁও ফ্লাইওভারের পশ্চিম পাশে বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতালের সময় ঈগল পরিবহনের একটি বাসে প্রকাশ্যে আগুন দিয়ে চালক বদর আলী বেগকে হত্যা করে। এই ঘটনায় খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় স্থানীয় জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীসহ অজ্ঞাত প্রায় ৫শ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এখনো সে মামলার তদন্ত শেষ হয়নি।

২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তরার আজমপুর এলাকায় চলন্ত বাসে আগুন দেয়ার ঘটনায় নিহত হন এবি ব্যাংক কর্মকর্তা রাসেল মাহমুদ। এই ঘটনায় উত্তরা-পূর্ব থানায় এসআই জাকির হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আজিজুল বারি হেলালকে। আরো আসামি করা হয় অজ্ঞাত ২শ জনকে। মামলার তদন্ত নেই বললেই চলে।

মতিঝিলের দিলকুশায় আগ্রণী ব্যাংকের লিফটম্যান জাফর মুন্সিকে পিটেয়ে হত্যা করে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এ ঘটনায় অগ্রণী ব্যাংক প্রধান শাখার নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক আসাদুজ্জামান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় জামায়াত-শিবিরের ১৪৫ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। কিন্তু সেটিরও কোনো অগ্রগতি নেই।

সূত্র আরও জানায়, ২০১৩ সালের ৩ মার্চ বগুড়ার নন্দিগ্রামের ৬টি ইউনিয়নের বিএনপি-জামায়াত জোট ব্যাপক নাশকতা চালায়। হরতাল-অবরোধ ডেকে তারা উপজেলা নির্বাহী ও মৎস্য অফিস, থানা, উপজেলা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ বাদী হয়ে দু’টি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা একটি, উপজেলা চেয়ারম্যান একটি, কৃষকলীগ সভাপতি একটি, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি করে মামলা করা হয়। ওইসব মামলায় বিএনপি-জামায়াতসহ জোটের অন্তত পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়। কিন্তু মামলা করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ পুলিশের তদন্ত।
এভাবে সিএমপি, আরএমপি, কেএমপি, সিলেট, কক্সবাজার বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, জয়পুরহাট, কুমিল্লা, খুলনা, বরিশাল, ফেনী, লক্ষ্মীপুরে দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনো চলছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘হরতাল ও অবরোধের নামে নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা মামলাসহ সব সহিংসতার মামলাই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হয়। এমন অনেক মামলারই তদন্ত শেষ হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের কারণেই কিছু মামলার তদন্তে দেরি হচ্ছে। এগুলো ঘটনার প্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়।’



মন্তব্য চালু নেই