দুঃসাহসী অভিযাত্রীর চোখে বাংলাদেশ
তরুণের নাম কিরন জেথওয়া। পেশায় ‘ফিয়ারলেস শেফ’ অথবা সোজা বাংলায় নির্ভীক রাঁধুনি। অ্যাডভেঞ্চার আর বৈচিত্র্যের সন্ধানেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের এই উপস্থাপক এসেছিলেন বাংলাদেশে। ঘুরেছেন ময়মনসিংহের মাছের হ্যাচারি থেকে সুন্দরবনসহ বহু জায়গা। কেমন ছিল সেই অভিযান?
ময়মনসিংহের ধলা রেলস্টেশন ছেড়ে ট্রেন তখন ঢাকার পথে। ট্রেনে উপচে পড়া ভিড়। ছাদেও মানুষ, যেন মেলা বসেছে। প্রচন্ড বাতাস উপেক্ষা করে সারি সারি মানুষ বোঁচকাসহ দিব্যি বসে আছে। কেউ কেউ ফেরিওয়ালার কাছ থেকে শিঙাড়া-সমুচা কিনেও খাচ্ছে। আবার কারও এসব কিছুতে মন নেই, দূরের আবছা সবুজ গ্রামে উদাস দৃষ্টি মেলে চুপচাপ বসে। বাংলাদেশের ট্রেনের ছাদের এ চেনা দৃশ্যই অবাক হয়ে দেখছেন একজন। বোঝাই যাচ্ছে এই দৃশ্য তাঁর কাছে নতুন। তবে নতুন কিছুতেই তাঁর যত আগ্রহ। মানুষটির নাম কিরন জেথওয়া। প্রথম পরিচয়, তিনি একজন শেফ বা রাঁধুনি। দ্বিতীয় পরিচয়, তিনি একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রী। এই দুটোকে এক করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পিপল চ্যানেলে ‘ফিয়ারলেস শেফ’ নামের এক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। একেক পর্বে ছুটে যান পৃথিবীর একেক প্রান্তে, অদ্ভুত কিছুর খোঁজে। সেখানকার বৈরী পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেন, মানুষের খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারা তুলে ধরেন। সবশেষে স্থানীয় উপকরণের সঙ্গে নিজের কৌশল খাটিয়ে নতুন কোনো খাবারের পদ তৈরি করেন।
অভিযান আর বৈচিত্র্যের খোঁজে কিরন ঘোরেন দেশে দেশেগত বছরের মার্চ মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন কেনিয়ার এই শেফ। বাঙালির মাছের প্রতি দুর্বলতা, সুন্দরবনের জেলেদের মাছ ধরার অদ্ভুত কৌশল, ময়মনসিংহে মাছের হ্যাচারি দেখা, কিরন জেথওয়ার বাংলাদেশ অভিজ্ঞতা ছিল ‘মাছময়’। অনুষ্ঠানটি সম্প্রতি প্রচারিত হয় ন্যাটজিও পিপল চ্যানেলে। দিন কয়েক আগে তাঁর বাংলাদেশ অভিজ্ঞতা জানতে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিরন তখন স্ত্রী আর শিশুকন্যার সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছেন কেনিয়ার সমুদ্রতীরে। সেখান থেকে ফিরেই যোগাযোগ করলেন।
ময়মনসিংহ থেকে শুরু হয় ফিয়ারলেস শেফের পঞ্চম পর্বের গল্প। সেখানে আবদুল বাতেনের মৎস্য খামার ঘুরে দেখেন কিরন। মাছের পোনার উৎপাদন এবং তা ঢাকায় পরিবহনের ধরন ছিল তাঁর আগ্রহের মূলে। ভাষাগত তারতম্যের কারণে আবদুল বাতেনের সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলতে না পারলেও তাঁর আতিথেয়তায় মুগ্ধ কিরন। তাঁর ভাষায়, ‘শুটিং শেষে আবদুল বাতেন আমাদের এক বেলা চমৎকার বাংলাদেশি খাবার খাইয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে এগুলো নেই। তবে সে খাবারের কথা আমার এখনো মনে আছে।’
কিরন অবাক হয়ে দেখলেন পোনা পরিবহনের দুটি পদ্ধতি। এক, মাছের অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ‘কমপ্রেসড এয়ার’ সঙ্গে নিয়ে যাওয়া। দুই, বড় বড় পানিভর্তি হাঁড়ি বা ড্রামে অবিরাম হাত নেড়ে বাতাস সরবরাহ করা। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি কিরনকে অবাক করেছিল। তিনি আরও অবাক হলেন, যখন শুনলেন পোনাগুলো ট্রেনের ছাদে করে টানা সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকায় পাঠানো হয়। পরদিন সকালে স্টেশনে ছুটে গিয়ে দেখেন, এমন পোনার হাঁড়ি নিয়ে সারি সারি অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছে। ট্রেনের ছাদে সবার এমন নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকায় কিরন খুব অবাক। ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের সময় তিনি একটু পরপর বিদ্যুতের তাঁর, গাছপালা থেকে শরীর বাঁচানোর জন্য রীতিমতো কসরত করছেন। দুজন আবার দুপাশ থেকে তাঁকে ধরে রেখেছে, যেন পড়ে না যায়। ক্যামেরার সামনে কিরন বারবার বলছিলেন, ‘ডোন্ট ট্রাই দিস অ্যাট হোম।’ কিরন কি ভয় পেয়েছিলেন? একটু সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বললেন, ‘ভয় পাইনি। তবে বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে এমন কাজ করে, তা দেখে অবাক হয়েছি। অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা।’
বাংলাদেশকে কেন এলেন? কিরনের সোজাসাপ্টা উত্তর-‘গল্প। গল্পের খোঁজে এসেছি। যেখানে অনুষ্ঠানের জন্য চমৎকার একটা গল্প পাওয়া যাবে। মাছে ভাতে বাঙালি। একথা মাথায় রেখেই কিরনের অনুষ্ঠানের প্রায় পুরোটাজুড়ে আছে মাছ। কখনো মাছের পোনা পরিবহন, কখনো মাছ ধরার কৌশল, আবার কখনো সেই মাছ দিয়ে খাবার তৈরি। কিরন বললেন, ‘এমন চমৎকার গল্পওয়ালা দেশ নির্বাচন কিন্তু আমাদের জন্য সহজই ছিল। একবাক্যে আমরা রাজি হয়েছি। ফিয়ারলেস শেফের অন্যতম সেরা পর্ব ছিল এটি।’ কিরন নজর দিয়েছেন আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত বা চালের দিকেও। ঢাকায় এসে কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজার ঘুরে দেখেন কিরন; বিশেষ করে মাছের বাজার। সারা দেশে চাষ করা মাছ ভোক্তাদের কাছে কীভাবে পৌঁছায়, সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। এখানেই কিরন পোলাওয়ের চাল দেখেন প্রথমবার। নিজের জন্য সঙ্গে নেন কিছু।
ট্রেনের ছাদে চড়ে ঢাকার পথে কিরন জেথওয়াপরের লক্ষ্য সুন্দরবন। ঢাকা থেকে ৩২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সদলবলে সুন্দরবন পৌঁছান কিরন। সুন্দরবনের জেলেদের প্রায় ২০০ বছরের পরম্পরা ভোঁদড় বা উদবিড়ালের সাহায্যে মাছ ধরা। আর এটাই এ অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল। মজার ব্যাপার হলো, এই ভোঁদড়গুলো কিন্তু জেলেরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাছ ধরায় দক্ষ করে তোলেনি। বাবা ও মা ভোঁদড় সেগুলো সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছে, সে বাচ্চারা বড় হয়ে আবার তাদের সন্তানদের তৈরি করেছে-এভাবে বংশপরম্পরায় চলে এসেছে। কোনো ভোঁদড় হারিয়ে গেলে এই জেলেদের আর কিছু করার থাকবে না। ভোঁদড় বিপন্নপ্রায় প্রাণী। এই জেলেরা বরং নিজেদের উপকারের স্বার্থেই ভোঁদড়ের বংশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
ভোঁদড়ের গলায় দড়ি বেঁধে পানিতে ছেড়ে দেন জেলেরা। সেগুলোর ঠিক পেছনেই থাকে জাল। ভোঁদড়গুলো খুঁজে বের করে-ঠিক কোথায় মাছ আছে। অনেক সময় গর্ত থেকে বের করে আনে।
মাছের খামার দেখা হলো, মাছ ধরা হলো, উপকরণ সংগ্রহ হলো। এবার পালা রাঁধুনির কারিশমা দেখানোর। তাজা চিংড়ি দিয়ে পোলাও ও বিরিয়ানির মাঝামাঝি একধরনের খাবার তৈরি করলেন কিরন। সঙ্গে ছিল কাঁচা আম, বেগুন, টমেটোসহ অন্যান্য দেশীয় উপকরণ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে সাত দিন ছিলেন কিরন ও তাঁর দল।
কিরন বলছিলেন, ‘ বাংলাদেশ খুবই বর্ণিল আর বৈচিত্র্যময় এক দেশ। সবারই জীবনে অন্তত একবার এখানে আসা উচিত।
এমন মানুষ, এমন কর্মব্যস্ত জীবন, নানা পদের খাবার-আর কোথায় মিলবে?’
আবদুল বাতেনের (মাঝে) হ্যাচারিতে কিরনফিয়ারলেস শেফের শুটিংয়ের জন্য বাংলাদেশে সাত দিন ছিলেন কিরন জেথওয়া। সঙ্গে তাঁর পাঁচ সদস্যের দেল-দুজন কেনিয়ান, তিনজন ব্রিটেনের। এঁদের মধ্যে পরিচালক হিসেবে ছিলেন থমাস হুইটওর্থ, ভিডিও ধারণ করেন ভিনসেন্ট এমবায়া। স্থিরচিত্র ধারণ করেন বার্নাবি ট্রেভলিন-জনসন এবং শব্দ প্রকৌশলীর কাজ করেন ডেভিড হ্যামিল। প্রযোজক এবং অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন কিরন জেথওয়া। এই পুরোটা সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের আরশাদ রন। পেশায় তিনি আলোকচিত্রী। ফিয়ারলেস শেফের সঙ্গে স্থানীয় প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি তাঁর কাজের অভিজ্ঞতার কথা জানান।
আরশাদ রন বলেন, ‘ফিয়ারলেস শেফের মূল প্রযোজক কিরনের স্ত্রী সারাহ। তাঁরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারপর, সবাই মিলেই শুটিংয়ের স্থান নির্ধারণ করা হয়। বিশ্ব ইজতেমার সময় ট্রেনের ছাদে করে যাওয়ার দৃশ্য সারা বিশ্বেই বেশ পরিচিত। সেখান থেকেই ট্রেনের ছাদের অংশ দৃশ্যায়নের কথা ভাবা হয়। ময়মনসিংহে ধলা নামে রেলস্টেশন আছে, যেখান থেকে প্রতি সকালে ট্রেনের ছাদে মাছের পোনা ঢাকায় পাঠানো হয়। যেহেতু মাছের সঙ্গে বাঙালির একটা গভীর সম্পর্ক আছে, তাই আরও খোঁজখবর করতে আমি ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম। সেখানে আবদুল বাতেনকে খুঁজে বের করি। তিনি তাঁর মাছের হ্যাচারির জন্য জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর হ্যাচারিতে অনুষ্ঠানের প্রথম অংশ ধারণ করা হয়।’
ধলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বাতেন কিরন জেথওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি এখানে এসেছিলেন, আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এই পুরো হ্যাচারি ঘুরে দেখেন, শুটিং করেন। সবশেষে আমার হ্যাচারির মাছ রান্না করে খাইয়েছিলাম তাঁকে।’সূত্র: প্রথম আলো
মন্তব্য চালু নেই