দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতকে ছাড়ছে না বিএনপি

মাঝেমধ্যে দুই দলের সম্পর্কের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেলেও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে আপাতত ছাড়ছে না বিএনপি। দেশের চলমান রাজনৈতিক দোলাচলে বর্তমানে কিছুটা কোণঠাসা বিএনপি ভবিষ্যতের ‘বন্ধুর পথ’ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই পাড়ি দিতে চায়। যদিও যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে পরিচিত জামায়াতের সঙ্গে মিত্রতা নিয়ে খোদ বিএনপির ভেতরে-বাইরে নানা মতপার্থক্য রয়েছে। তবুও জামায়াতকে সঙ্গে নিয়েই ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী শক্ত অবস্থান গ্রহণ এবং নির্বাচন করতে চায় বিএনপি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা এ কথা স্বীকার করেন।

১৯৯৮ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলন, জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী সরকার গঠন- এই তিন ইস্যুতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোটভুক্ত হয় জামায়াত। পরবর্তী সময়ে ২০০১-২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের সরকারে অন্যতম অংশীদার ছিল জামায়াত। চার দলের কলেবর বৃদ্ধি হয়ে বর্তমানে এটি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। আর এই জোটে জামায়াতের অবস্থান দ্বিতীয়। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধেও সে সময় আন্দোলন করেছে জামায়াত।

‘বিএনপি-জামায়াত’-এর মিত্রতা প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমাদের সঙ্গে জামায়াতের আদর্শিক মিল নেই। তবে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের রাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের মিল রয়েছে। তাই ‘বিএনপি-জামায়াত’ হলো চলমান রাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক জোট। তিনি বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে অন্যান্য শরিক দলের মতো জামায়াতও রয়েছে। এই জোট দীর্ঘদিন ধরে দেশের হারানো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাই এটাকে নির্বাচনী জোটও বলা যেতে পারে। আর জামায়াতের সঙ্গে এমন ‘বোঝাপড়া’ ’৯৪, ’৯৫, ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থিরাও করেছিল তখনকার বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে।

‘বিএনপি-জামায়াত’-এর বর্তমান সম্পর্ক প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে রুহুল কবির রিজভী বলেন, জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক অটুট রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত’ সম্পর্কের শীতলতা নিয়ে বাইরে যে কথাবার্তা রয়েছে, তা সঠিক নয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এখন পর্যন্ত শক্তিশালী এবং ভবিষ্যতের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ জোট কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

এদিকে এক অনুসন্ধানে জানা যায়, গত মঙ্গলবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ২০ দলীয় জোটের বৈঠক। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে গণমাধ্যমে বিএনপির আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে জোটের শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়া মিত্র রাজনৈতিক দলের প্রধানদের নিয়ে এ বৈঠক করেন। আর সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘বিএনপি-জামায়াত’ সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা থাকলেও জোটের এই বৈঠকে জামায়াতের একজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। পূর্বনির্ধারিত এ বৈঠকে ২০ দলীয় জোটের প্রধান নেতাদের অংশ নেয়ার কথা থাকলেও জামায়াতের বেলায় ঘটে ব্যতিক্রম। জামায়াতের পক্ষে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মাওলানা আবদুল হালিম এতে অংশ নেন।

এ বৈঠকে জামায়াতের এই সিনিয়র নেতা অংশ নিলেও কৌশলে উপস্থিত গণমাধ্যমকে এড়িয়ে যান। গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মাওলানা আবদুল হালিমও জোটনেত্রী খালেদা জিয়ার ডাকা প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলা এ বৈঠকে উপস্থিত থাকেন। বৈঠক শেষে জোটের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন ইসির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গণমাধ্যমের সামনে আসেন। তখন জোটের অন্যান্য শীর্ষ নেতা অথবা তাদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও জামায়াতের প্রতিনিধি থাকেননি। বরং মির্জা ফখরুলের সংবাদ সম্মেলন শুরুর মাত্র ২ মিনিট আগে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে যেতে দেখা যায় মাওলানা আবদুল হালিমকে।

এর আগে গত ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চুপ ছিল জামায়াত। জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতের এমন নীরবতা নিয়ে তখন নানা ধরনের কানাঘুষা চলেছে ২০ দলীয় জোটে। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ কর্তৃক নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হলে বিএনপির সঙ্গে জোট শরিকদের বৈঠকগুলোতে জামায়াতের প্রতিনিধিদের অংশ নিতে দেখা যায়। এ ছাড়া গত নভেম্বরে রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রূপরেখা উপস্থাপনের সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। তবে এই সংবাদ সম্মেলন ঘিরে প্রস্তুতি পর্বে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াত অংশ নেয়।

জামায়াত প্রসঙ্গে বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াতকে ছাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ তারা দেখছেন না। বরং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অখণ্ডতা ধরে রেখে ভবিষ্যতে সরকারবিরোধী শক্ত অবস্থান গড়ে তোলাই বিএনপির বড় টার্গেট। আর এই টার্গেট অর্জনে জামায়াতের জনসমর্থন, অর্থিক ও সাংগঠনিক শক্তি, আন্তর্জাতিক লবিং, আনুগত্য, রাজপথের আন্দোলনে পূর্ব-অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায় বিএনপি।

সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক মো. তাসনীম আলম এক বিবৃতিতে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। সরকারের শত জুলুম-নির্যাতনের মোকাবিলা করেই আল্লাহর রহমতে জামায়াতে ইসলামী টিকে আছে। জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের গঠনতন্ত্র মোতাবেক পরিচালিত হচ্ছে। সংগঠনের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল থাকার প্রশ্নই আসে না। জামায়াতে ইসলামী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভাকাক্সক্ষীদের প্রদত্ত অর্থেই পরিচালিত হয়ে থাকে। শত বাধাবিপত্তি এবং প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জামায়াতের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে এবং জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মধ্যে জামায়াতের অবস্থান দুর্বল হওয়ার প্রশ্ন অবান্তর।’

প্রসঙ্গত, গত আট বছর ধরেই জামায়াত রাজনৈতিকভাবে বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দলের শীর্ষ ও সিনিয়র নেতাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মৃত্যুদণ্ডও হয়েছে সংগঠনের শীর্ষ কয়েকজন নেতার। আর সংগঠনটির সাধারণ কর্মীরা কিছুদিন নিজ ঘরে বসবাস করতে পারলেও অর্ধযুগ আগে থেকে পদধারী নেতারা ফেরারি জীবন যাপন করছেন। এ ছাড়া জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলীয় প্রতীক ছিল ‘দাঁড়িপাল্লা’। গত বছর দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে বলা হয়, ‘দাঁড়িপাল্লা’-কে দলীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এর আগে ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।

এই যখন অবস্থা, তখন আনা হয়েছে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন। মাওলানা মকবুল আহমাদ সংগঠনের নতুন আমির এবং ডা. শফিকুর রহমান সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হয়েছেন। টিকে থাকার জন্য আরপিও মতে, দলীয় গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন এনেছে জামায়াত। আগে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ হিসেবে পরিচয় দিলেও তা বদল করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম নামকরণ করা হয়েছে। টিকে থাকার চেষ্টায় নাম পরিবর্তন করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। দেশের রাজনীতিতে সাংগঠনিক শক্তির বিচারে আওয়ামী লীগ-বিএনপির পর সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল জামায়াত। ভোটের রাজনীতিতে কখনো তৃতীয়, কখনো চতুর্থ অবস্থানে থাকা এই সংগঠনটি আর্থিকভাবেও বুনিয়াদি। এখন এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে।



মন্তব্য চালু নেই