দিয়াজের মৃত্যুর আগে টেন্ডার নিয়ে যত ঘটনা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘আত্মহত্যা’ বলা হলেও অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। দিয়াজের পরিবারসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অনেকেই মনে করেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। কেউ কেউ এজন্য টেন্ডার বিতর্ককে সামনে আনলেও অনেকে আবার একে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেছেন।
তবে, সরেজমিন অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে টেন্ডার নিয়ে অনেক ঘটনার খোঁজ পাওয়া গেছে। পুলিশও বলছে, আদালতের নির্দেশে তারা যে অধিকতর তদন্ত করছে তাতে ‘টেন্ডারবাজি’ এবং এরকম অন্য বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ক্যাম্পাস সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এরইমধ্যে মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া কমিটি গঠনের পর দ্বন্দ্বের বিষয়টি আরো প্রকাশ্য হয়। সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছিলেন দিয়াজ। তবে, আলমগীর টিপুকে সভাপতি এবং ফজলে রাব্বী সুজনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়, আর দিয়াজের স্থান হয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে। এর মধ্যে টিপু এবং দিয়াজ দুজনই বর্তমান মেয়র আজম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অপরদিকে সুজন পরিচিত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে।
মূলতঃ এই দুই নেতাই তাদের অনুসারীদের মাধ্যমে দুই দশকের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে শাটল ট্রেনের বগি ভিত্তিক গ্রুপগুলোর প্রভাবও কমবেশি ছিল। কিন্তু বর্তমান কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর তা বড় আকার ধারণ করে। বিভিন্ন সময় খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়েও শাটল ট্রেন ভিত্তিক গ্রুপগুলো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কারণ এই গ্রুপগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে অনেক ছাত্রলীগ নেতা সরাসরি জড়িত আছেন।
এসব গৃুপের মধ্যে ‘সিক্সটি নাইন’, ‘ভিএক্স’, ‘একাকার’, ‘উল্কা’, ‘এপিটাফ’, ‘বাংলার মুখ’, ‘কনকর্ড’ গ্রুপগুলো আজম নাছিরপন্থী। আর বিজয় গ্রুপে রয়েছেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা।
টিপু ‘সিক্সটি নাইন’ এবং দিয়াজ ‘বাংলার মুখ’ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
টেন্ডার নিয়ে দ্বন্দ্ব
সরেজমিন তদন্তে উঠে এসেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সব টেন্ডারের পেছনে আছে দুই সাবেক ছাত্রনেতার নাম। তারা হলেন সাবেক সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী এবং সাবেক সহসভাপতি আবুল মনসুর জামশেদ। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক যাবতীয় টেন্ডারের মূল নিয়ন্ত্রক এই দুজন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ৭৭ কোটি টাকা খরচে কলাভবন সম্প্রসারণ এবং ২০ কোটি টাকা খরচে শেখ হাসিনা হল বর্ধিতকরণের টেন্ডার আহবান করা হয়। এই টেন্ডারকে কেন্দ্র করে নতুন করে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, দুটি কাজের জন্য শিডিউল বিক্রি করা হয় ১৮ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর। শিডিউল কিনতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর থেকে। ফরম জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর। আর এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তর অবরোধ করে রাখে ছাত্রলীগ। ফলে ছাত্রলীগের পছন্দের বাইরে শিডিউল কিনতে পারেনি কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
যে কারণে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে
নভেম্বরের শুরুর দিকে মেসার্স দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জিকেবিএল (জেভি)-কে ৭৭ কোটি টাকা খরচে নতুন কলা ভবন নির্মাণের এবং মেসার্স মঞ্জুরুল আলম চৌধুরীকে ২০ কোটি টাকা খরচে শেখ হাসিনা হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যাদেশের জন্য মনোনীত করা হয়।
নতুন কলা ভবনের টেন্ডার নিয়ে শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি আলমগীর টিপু ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজনের সঙ্গে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর দ্বন্দ্ব ছিল। টিপু-সুজন অবস্থান নেন ঢাকার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে। আর চট্টগ্রামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ছিলেন দিয়াজ।
টেন্ডার প্রক্রিয়ায় বঞ্চিত হওয়ায় দিয়াজের অনুসারীরা টেন্ডার শিডিউল কেনার শেষ দিন ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবরোধের ডাক দেয়।
২৫ লাখ টাকায় সমঝোতা!
ছাত্রলীগের ভেতরের সূত্রগুলো জানায়, টেন্ডার শিডিউল কেনার শেষদিন ঢাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে ক্যাম্পাসের দুই নম্বর গেইট এলাকায় দিয়াজের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে দর কষাকষির এক পর্যায়ে তারা দিয়াজের অনুসারীদের জন্যে ২৫ লাখ টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিময়ে দিয়াজের ‘বাংলার মুখ’ ও ‘ভিএক্স’ গ্রুপের কেউ ঢাকার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোন কর্মকাণ্ড চালাবে না বলে কথা পাকাপাকি হয়।
পরদিন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দিয়াজকে ২৫ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। চুক্তি হয় ওই প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পেলে চেকের টাকা উঠানো হবে।
হামলা-পাল্টা হামলা
কিন্তু ওইদিন অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর দিয়াজের অনুসারী বলে পরিচিত ছাত্রলীগের তিন সহসভাপতি অভি, মাসুম এবং রাশেদ ইঞ্জিনিয়ার ভবনে দরপত্র জমা দিতে গেলে তাদের উপর হামলা হয়। সেখান থেকে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
ঘটনার সূত্র ধরে ২৮ সেপ্টেম্বর দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগের সহসম্পাদক বিপুলের উপর হামলা হয়। এ নিয়ে মামলাও হয় ৭ জনের বিরুদ্ধে। আবার পাল্টা হামলা হয় শাহীনের উপরে। চাপাতির আঘাতে শাহীন মারাত্মক আহত হন। এই ঘটনায় দিয়াজ গ্রুপের ৭ জনের বিরুদ্ধে হয় পাল্টা মামলা।
হামলা-পাল্টা হামলা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি ৭ দিনের মধ্যেই তাদের রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘ভিএক্স’ গ্রুপের তিনজনকে দুই বছর আর ‘একাকার’ গ্রুপের তিনজনকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করে। এরপর থেকে দিয়াজ গ্রুপ অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে।
তবে চলতে থাকে অন্তঃকোন্দলের ধারাবাহিকতা।
এর রেশ ধরে ২৮ অক্টোবর আব্দুর রব হলের সামনে হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগের সহসভাপতি তপুকে গুরুতরভাবে আহত করে কয়েকজন মুখোশধারী। ঘটনার জন্য টিপু গ্রুপ দায়ী করে দিয়াজকে। তারা দিয়াজ-মামুনসহ ৭/৮ জনের বাড়ীতে লুটপাট ও ভাংচুর চালায়। তপুর উপর হামলা ও দিয়াজের বাড়ীতে লুটপাট নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মামলা হয়।
কয়েকদিন পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একটি দল সরেজমিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে এবং কয়েকজনকে আজীবন বহিষ্কারের জন্য সুপারিশ করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে দিয়াজ গ্রুপ সিটি মেয়র আজম নাছিরের অনুমোদনক্রমে আবারো ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয়। কিন্তু উৎসবে ছাত্রলীগের তেমন কোন অংশগ্রহণ ছিল না। এমনকি কোন টেন্ট পর্যন্ত ছিল না তাদের।
সুবর্ণ জয়ন্তী শেষ হওয়ার পরদিন ২০ নভেম্বর দিয়াজের বাড়িতে তার ঝুলন্ত লাশ পাওয়া যায়। তার মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা– এ নিয়ে এরপর থেকে বিতর্ক চলছে।
কথিত প্রেমিকাকে নিয়ে গুজব
কিছু গণমাধ্যমে দিয়াজের কথিত এক প্রেমিকার বিষয়টি উঠে এলেও সরেজমিন অনুসন্ধানে সে ধরণের কোন বিষয়ের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। দিয়াজের ঘনিষ্ঠজনরা বলেছেন, দিয়াজের সঙ্গে ওই মেয়েটির সুসম্পর্ক থাকলেও তা খুব বেশি ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে পৌঁছেনি কখনো।
এ ব্যাপারে মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি, তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ আছে।
এর মাঝেই দেয়া হয় পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যাতে দিয়াজের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে দিয়াজের পরিবার ও অনুসারীরা।
দিয়াজের মায়ের মামলা
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যার কথা এলেও তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়াজ ইরফান চৌধুরীকে হত্যার অভিযোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি প্রক্টর ও ছাত্রলীগ সভাপতিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পরিবার। দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিবলু কুমার দের আদালতে মামলা দায়ের করেন।
দিয়াজের বোন জুবেয়দা সারোয়ার চৌধুরী জানান, তারা মামলার আর্জিতে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১, ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ এনেছেন। আদালত তদন্ত শেষে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছে বলে জানান তিনি।
মামলায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু, কর্মী রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরোব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে ।
সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মামলায় তার নাম কেন আসলো এটা তিনি বলতে পারবেন না। তিনি বলেন, মামলার বিষয়টি এখন আদালতের বিষয়। তদন্ত সাপেক্ষে এখন আদালত বলবেন। ‘আমিও চাই বিষয়টির তদন্ত হোক।’
ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জামশেদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে অনেকের সঙ্গেই আমার যোগাযোগ থাকতে পারে।
মামলার আসামী ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
নিরাপত্তা চায় দিয়াজের পরিবার
দিয়াজের মামা রাশেদ বিন আমিন চৌধুরী কাউকে দোষারোপে না গিয়ে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়েছেন। যোগাযোগ করা হলে মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে তিনি বলেন: ‘বিশ্ববিদ্যালয় শান্ত থাক, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গসংগঠন ভালো থাক। হত্যায় মোসাদের স্টাইল ফলো করা হয়েছে বলে ধারণা করি। কোন ব্লেম গেম নয়। নিরাপত্তা চাই নিজের, পরিবারের। বাংলাদেশ আমার প্রিয় স্বদেশ ভালো থাক।’খবর চ্যানেল আই’র।
মন্তব্য চালু নেই