দল ক্ষমতায় : ঘরে ঘরে ভুঁইফোড় লীগ

দল যখন ক্ষমতায় না থাকে তখন তাদের দেখা মেলে না। ক্ষমতায় এলেই ওরা গড়ে তোলে নিত্যনতুন লীগ। সুবিধাভোগীরা গত দুই বছরে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে গড়ে তুলেছে নতুন নতুন সংগঠন। এর মধ্যে ঢাকা নগরীতে পোস্টার দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী পরিবার লীগ, আল্লাহওয়ালা লীগ, মিডিয়া লীগসহ আরও অনেক সংগঠনের। আওয়ামী লীগের অনুমোদন করা সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন থাকার পরও নিত্যনতুন লীগ গড়ে ওঠাকে বিস্ময়কর সুবিধাবাদী অবস্থান বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে ধান্দাবাজি আর চাঁদাবাজির মতলবেই সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে এরা গজিয়ে ওঠে।

জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে একের পর এক সংগঠন আচমকা যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের পেছনে ‘লীগ’ শব্দ জুড়ে তো দিচ্ছেই, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামও জুড়ছে। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করেও নিজের জানান দিচ্ছে অনেক সংগঠন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব নামসর্বস্ব সংগঠন গড়ে উঠছে মূলত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে। আর এই শাস্তিহীনতার সুযোগ নিয়ে এর অপব্যবহার করছে সুবিধাভোগী মহল। তারা বলছেন, ভুঁইফোড় এসব সংগঠন মূলত লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড, ব্যানার-ফেস্টুনসর্বস্ব। বাস্তবে এসব সংগঠনের কোনো কার্যক্রম যেমন নেই, তেমনি নেই কোনো কার্যালয়ও। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোনো নেতার ছবি দিয়ে পোস্টার, ব্যানার-ফেস্টুন ছাপানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজধানীসহ সারা দেশে অলিগলি এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতাদের বড় বড় ছবিতে ছেয়ে গেছে। কিন্তু এদের একজনের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে স্বীকৃত সাতটি সহযোগী ও দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। সহযোগী সংগঠনগুলো হচ্ছে যুবলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও তাঁতী লীগ। ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হলো ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ। দলের গঠনতন্ত্রে এর বাইরে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। বাকি সব ভুঁইফোড়। এসব সংগঠনের দায় নেতারা নিতে না চাইলেও বিস্ময়কর হচ্ছে, তাদের নানান কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা এমনকি মন্ত্রীদেরও সহাস্য উপস্থিতি দেখা যায়।

এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে পুলিশি অ্যাকশন গ্রহণ করা উচিত বলে মন্তব্য করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে অনুরোধ করব অতিদ্রুত ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। দলের অনুমোদিত সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাড়া কেউ লীগ, বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনকের পরিবারের নাম ব্যবহার করলেই প্রয়োজনে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। না হলে এরা দলের নাম ভাঙিয়ে যেসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে, দায়ভার আওয়ামী লীগকেই বহন করতে হবে। ’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ৬৮ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর একটি মহল নিজেদের নানারূপ অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিতে আওয়ামী লীগের নাম যুক্ত করছে। এরা দলের কাজে যতটুকু না তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত নিজেদের সুবিধা আদায় করতে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব অবাঞ্ছিত সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিছু আওয়ামী লীগ নেতা আর মন্ত্রী গিয়ে বক্তৃতা করেন। এতে অপকর্মপটুরা উৎসাহ পায়। দ্রততম সময়ের মধ্যে এই রাজনৈতিক মৌসুমি দোকানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দল ও দেশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ’

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘এসব মতলবাজ, ভুঁইফোড় সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই। নামের আগে লীগ, বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নাম যুক্ত করে কোনো অপকর্মে যুক্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভুঁইফোড় এসব সংগঠনের নেতাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ’

জানা গেছে, মূল দল আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের স্বীকৃতি না থাকলেও এর সংগঠকরা নিজেদের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করে বিভিন্ন দফতরে সুবিধা আদায় ও নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গত আট বছরে দলটির নামের সঙ্গে মিল রেখে আত্মপ্রকাশ করেছে এমন দুই শতাধিক সংগঠন, মিডিয়াপাড়ায় যা ‘রাজনৈতিক দোকান’ নামে পরিচিত। কেন্দ্রীয়ভাবে এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় উত্তরোত্তর এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আয়োজকদের মূল কাজ হচ্ছে মন্ত্রী-এমপি ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক করা, যা ব্যবহার করে নানা অপরাধ, অপকর্মে লিপ্ত হয় তারা। এতে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় বলে এসব অনুষ্ঠানে নেতাদের যেতে নিষেধ করা আছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের। কিন্তু এসব থোড়াই আমলে নেন সংগঠনগুলোর সুযোগসন্ধানীরা। দিনে দিনে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন ‘দোকান’। ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী পরিবার লীগ’ নামের সংগঠনটি এরই সর্বশেষ সংযোজন। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী পরিবার লীগের সভাপতির একটি ভিজিটিং কার্ড এই প্রতিবেদকের চোখে পড়ে। কার্ডটির এক পাশে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ও শেখ রাসেলের ছবি। অন্য পাশে শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি। মাঝখানে লেখা আবুল কাশেম (মুক্তিযোদ্ধা), সভাপতি, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী পরিবার লীগ। দুটি মোবাইল ফোনের নম্বরও দেওয়া আছে। আর নিচে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা লেখা হয়েছে— ‘২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, ঢাকা-১০০০’। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা। বর্তমানে কার্যালয়টি নির্মাণাধীন থাকায় ১৯ বঙ্গবন্ধু এভিনিউর একটি ভবন ব্যবহার করা হচ্ছে। আবুল কাশেমের দাবি, অস্থায়ী কার্যালয়ে ছাত্রলীগের অফিসের পাশের রুমটি আপাতত তাদের দেওয়া হয়েছে। তার দাবি, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রতিদিন তার সঙ্গে ফেসবুকে কথা হয়। আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন। তিনিই আমাকে সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ ছাড়া তোফায়েল ভাই (বাণিজ্যমন্ত্রী), শাজাহান ভাই (নৌপরিবহনমন্ত্রী), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ভাই ও দীপু মনি আপার সঙ্গে প্রতিদিন ফেসবুকে কথা হয়। ’

কয়েক সপ্তাহ ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে কেন্দ্রীয় ‘আল্লাহওয়ালা লীগ’ নামে একটি ভুঁইফোড় সংগঠনের। আবদুর রশিদ শেখ দুলাল ফকির ওরফে দুলাল সাধুর বার্ষিক উরস উপলক্ষে এ পোস্টার করা হয়েছে। বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার বিরইলে ওই উরস ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। ‘মিডিয়া লীগ’ নামে নতুন আরেকটি সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কার্ডে দুটি ফোন নম্বর পাওয়া গেলেও তা বন্ধ রয়েছে।

এর আগে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ’ নামের সংগঠনটির সাইনবোর্ডের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এ সংগঠনটির প্রধান কার্যালয় ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে নয়, কেরানীগঞ্জে। এর প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসু সরদার। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজের মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করে ব্যানার ছাপিয়ে আলোচনায় আসে ‘অভিভাবক লীগ’। এর আগে এ সংগঠনের নাম শোনেনি কেউ। শুধু অভিভাবক লীগই নয়, জানুয়ারিতে গঠন করা হয়েছে ‘ইতিহাস চর্চা লীগ’ ও ‘অধিকার আদায় লীগ’ নামে দুটি সংগঠন। এ ছাড়া এর আগে বাজারে আসে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী শিশু লীগ’ নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ডেমরা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ফয়সাল আহাম্মদ মুন্সী। তিনি পাড়াডগাইর ‘ডগাইর বাজার’ এলাকার কাজীও। তিনি তিন বছর ধরে সংগঠনটির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী তৃণমূল লীগ নামেও এক দোকান চালু হয়েছে বেশ কিছু দিন আগে। আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা দিয়ে লোগো এক পাশে বঙ্গবন্ধু, অন্য পাশে শেখ হাসিনার ছবি। ছবি আছে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়েরও। এরপর ন্যায়-নীতি প্রকাশের চেষ্টায় চোখা কিছু শব্দ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে স্লোগান। শব্দগুলো হলো নীতি-আদর্শ, স্বচ্ছতা-চরিত্র, সততা-একতা। ভোগে নয়-ত্যাগে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ আওয়ামী তৃণমূল লীগ ব্যানার-পোস্টার করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ সংগঠনটি ২০১২ সালে গড়ে উঠেছে। এর সভাপতি শাহেদুল আলম টিপু।



মন্তব্য চালু নেই