তুরাগ পাড়ে বিষাদের ঈদ
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ: সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টি ভেজা ঈদ। সারাদেশে। শুধু ঈদ নেই তুরাগের পারে। যেখানে সাড়িবদ্ধ শুয়ে ছিল চেনামুখগুলো, এই তো গেলদিন বিকেলেও। আনন্দরা পুড়ে গেছে। সাদা পায়রার দেশে পোড়া আনন্দ শব হয়ে মিশে গেছে, দিক থেকে দিগন্তে। ক্লান্তহীন শ্রম বিকিয়ে যাদের জীবন চলতো। কষ্টের ফেরিওয়ালা মানুষগুলো কতগুলো কষ্ট বিলিয়ে হারিয়ে গেছে। তারা কি আর ফিরবে? ফিরেছে কেউ কোনোদিন, সেখান থেকে?
গাঁয়ে মা, বৃদ্ধ বাবা পথ চেয়ে ছিল, ছেলে ফিরবে। সঙ্গে তার রাঙা বউ। আর আদুরে ছোটো ছোটো সোনামুখ। আড়াই মাস আগে ঈদ শেষে ঢাকায় ফেরার আগে বলেছিল, দাদু এই ছাগল ছানাটাকে দেখে রেখো? আমি যেন আবার এসে ওকে পাই। দাদু পেলেপুষে যতনেই রেখেছে দূরন্ত ছানাটা। কিন্তু যার ফেরার কথা ছিল, ফিরে গিয়ে দেখার কথা ছিল, সে তো আর ফিরছে না। সোনামুখটা এখন খুঁজে ফিরছে জন্মদাতার মুখ। ঝলসে যাওয়া মুখে চেনা মানুষকেও যে বড়ই অচেনা লাগছে! গতবার বাড়ি ফেরার সময় পথে সেকি ভিড়। সেই ভিড়ে ছোটো মুখটা একবার হারিয়ে যেতে বসেছিল। তারপর বাবা, হ্যাঁ বাবাই তো তাকে দৌড়ে কোলে নিল। আজ মর্গের ভিড়ে সেই বাবাকেই হারিয়ে ফেলেছে ছেলেটা।
গল্পগুলো কাল্পনা নয়। গল্প কখনো সত্যিও হয়। তুরাগ পাড়ের টঙ্গীর টাম্পাকো এমন প্রায় অর্ধশত গল্পের রচনা করেছে। এই তো দিন চারেক আগের ঘটনা। শুক্রবার রাতভর একদল শ্রমসেনা কাজ করে কারখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে পোড়ামুখ দেখছিল। হাসি ছিল মুখে। না, তখনও মুখগুলো পোড়েনি। আগে থেকেই ঠিক ছিল শনিবার কাজ শেষে ঈদের ছুটি। তারপর বাড়ি ফেরা। বাসায় স্ত্রী, সন্তানকে তৈরি থাকতে বলে কাজে এসেছিল মানুষটি। ব্যাগগুলো তৈরি ছিল আরও আগে। প্রিয়জনের জন্য কেনা নতুন কাপড় বেশ গুছিয়ে ব্যাগে নিয়েছিল। বাসা থেকে বেরোবার আগে বলেছিল, এই তো আমি ফিরবো দুপুরে। এসে কিন্তু দেরি করবো না একদ-। কেউ হয়তো সন্ধ্যেয় ফেরার কথা বলে দিনের আলোতেই সন্ধ্যা নামিয়ে আনলো।
তালিকাটা দীর্ঘ হচ্ছে। মনে হচ্ছে আগে থেকেই এক, দুই, তিন, চার করে ক্রমিক বসানো একটা কালো ছকে। এখন শুধু বসছে একের পর এক নাম। স্পেকটার্ম, তাজরীন, রানা প্লাজা, সবশেষ টাম্পাকো। ক্রমিকগুলো বোধ হয় এখনও খালি। হায়! এই বোধ যদি থাকতো, পুঁজিপতিদের। যারা আরাম চেয়ারে হেলান দিয়ে স্বপ্নবোনে। টাম্পাকোর আগুনে পুড়ে যাওয়া মুখগুলোরও তো স্বপ্ন ছিল। খুব বড় তো ছিল না তাদের স্বপ্ন। কিন্তু বড়স্বপ্নবাজদের কালো ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে আজ তারা নিজেরাই কয়লা হয়ে গেছে।
টঙ্গীতেও নিয়ম করে ঈদের জামাত হয়েছে। কোরবানি হচ্ছে পশু। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। দুদিন আগে যে মাটিতে শোয়ানো ছিল ঝলসে যাওয়া, খ-িত শরীরগুলো। রক্তগুলো কালো হয়ে গিয়েছিল। পশুর রক্ত আর শ্রমের রক্তের মধ্যে খুব বেশি তফাত ছিল? দুটোই ত্যাগ। একটি মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য। আর শনিবার ভোরে পুড়ে যাওয়া রক্ত সৃষ্টির সন্তুষ্টির জন্য। সৃষ্টিকর্তার হিসেবে বড় জটিল হয়। এখানে সমীকরণ মেলে না। মেলানো সম্ভব না।
লোকমুখে শুনেছি, এখনও বৃষ্টি মাথায় করে স্বজনরা ভিড় করে বিসিকে পুড়ে যাওয়া, ধসে যাওয়া, খসে যাওয়া ধ্বংসস্তুপের কাছে। শুনে আমার রানা প্লাজার কথা মনে পড়ে যায়। দিনে দুপুরে ধসে পড়ার পর থেকে স্বজনদের ভিড় একটা ধ্বংসস্তুপের সামনে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস। যারা তারপরও খোঁজ পায়নি স্বজনের তারা নাকি এখনও মনে হলে গিয়ে দাঁড়ায় কাঁটাতারে ঘেরা ধ্বংসচিহ্নের সামনে। টাম্পাকোর সামনেও হয়তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস স্বজনের ভিড় লেগে থাকবে। হাতে থাকবে স্বজনের ছবি। মিলিয়ে নেয়ার আকাক্সক্ষায় নির্জীব দেহ। কিন্তু আদৌ কি ফিরবে প্রিয়মুখ? স্বজনের নাকে এখনও লাগে লাশের গন্ধ। বাতাসে ছড়িয়ে গেছে দূর থেকে দূরে। ছড়াচ্ছে এখনও। আর ভিড় বাড়াচ্ছে স্বজন হারা মানুষের।
নাকে সিঁধিয়ে যাওয়া এই গন্ধ লাশের নয়। এই গন্ধ বিবর্জিত মানবতার, লেলিহান যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া প্রাণের, বিবেকহীনতা আর উদাসীনতার।
কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতায় যতটুকু জানি, ব্রয়লার বা এ জাতীয় যন্ত্রাংশগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর পরীক্ষা করতে হয়। বিকল হয়ে আসারও একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। তখন তা বদলে ফেলা বা মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। তা না হলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারবে না কেউ। বরং যেকোনো সময় ভয়াবহ ধ্বংসলীলা দেখতে হবে। টাম্পাকো কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জীবনকে জীবন বলে মনে করতো না বোধ হয়।
যে জীবন কারখানার যান্ত্রিক আতিসজ্জে প্রাণের সঞ্চার করেছে, সেই জীবনকে মূল্যহীন মনে করার খেসারত কি দিতে হবে না তাদের? পালিয়ে বাঁচতে পারবেন লিচু মিয়ারা? দিনের পর দিন লিচু মিয়াদের এই স্বেচ্ছারিতা, উদাসীনতা আর দায়িত্বে অবহেলার কোনো বিচার কি হবে না? শুধু মামলাতেই যেন আটকে না থাকে পোড়া আত্মার খেদ। একটু দেরি করে অফিসে যাওয়ার কারণে যেখানে শ্রমহাতের মজুরি কেটে নিতে দ্বিধা করতো না কেউ, সেখানে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের এতবড় দায়িত্ব অবহেলার বিচারের দাবি শতভাগ যৌক্তিক। এমনটা যেন না হয়, ‘বড়বাবু বললেন, আমি বললাম,/ আমি বললাম, বড়বাবু বললেন,/ শেষকথা বলবেন আপনারা। বলতে বলতে/বলতে বলতে/ মুখে ফেনা বেরিয়ে গেল/ এখন শুনছি বড়বাবুরও বড়বাবু আছে।’
বড় বড় খুনি, অপরাধী, পলাতক সন্ত্রাসী খুঁজে বের করতে পুলিশের খুব বেশি সময় লাগে না, তা আমরা জানি। কিন্তু শতশত শিল্প হাত কয়লা করে যে শিল্পপতি ‘লুকিয়ে আছে’ তাকে খুঁজে পেতে কালক্ষেপণ কি মানা যায়? সারাদেশে ঈদের চেয়ে টঙ্গীর এবারের ঈদ পুরোপুরই ভিন্ন। এই ভিন্ন ঈদ আমরা আর চাই না। বিষাদের নয়, আনন্দের ঈদ চাই।
লেখক: প্রধান প্রতিবেদক, সাপ্তাহিক এই সময়
মন্তব্য চালু নেই