তুরস্কের চোখে যুদ্ধাপরাধী নন নিজামী!

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে আবারো নজিরবিহীন মন্তব্য করেছে তুরস্ক। দেশটির শীর্ষস্থানীয় এক কূটনীতিক বলছেন, নিজামী কোনো যুদ্ধাপরাধী নন, বরং একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

দিল্লিতে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ড. বুরাক আকচাপার বিবিসি বাংলাকে এক স্বাক্ষাৎকার দিয়েছেন। স্বাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত বলেন, নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য ‘বিরাট এক ভুল’ হিসেবে দেখছে তুরস্ক।

এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর প্রধানের ফাঁসি কার্যকর করায় ইসতাম্বুল ক্ষুব্ধ এবং তা প্রকাশ করাটা তুরস্কের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। একইসঙ্গে তার দেশ নিজামীকে কোনো যুদ্ধাপরাধী নয়, বরং একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই দেখছে।

নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করার প্রতিবাদে তুরস্ক ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তীব্র ভাষায় এই ফাঁসির নিন্দা জানিয়েছেন।

১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দেওয়া হয় গত সপ্তাহে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশের সমালোচনা করেছে অনেক দেশই। কিন্তু তুরস্ক যে ভাষা ও ভঙ্গীতে তাদের প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছে তা প্রায় নজিরবিহীন।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিজামীর ফাঁসির আগে ও পরে বারবার এই পদক্ষেপের নিন্দা করেছেন, এমনকী ইউরোপ কেন এই প্রশ্নে নীরব, সে প্রশ্নও তুলেছেন। ফাঁসির পর তুরস্ক বাংলাদেশ থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নেওয়ায় আঙ্কারা ও ঢাকার কূটনৈতিক সম্পর্কও এখন হুমকির মুখে।

বাংলাদেশের নিজস্ব একটি বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তুরস্ক কেন এত কঠোর অবস্থান নিয়েছে, দিল্লিতে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত বুরাক আকচাপারের কাছে তা জানতে চাইলে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, তুরস্কের এই কঠোর অবস্থান সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। আকচাপার আপাতত ঢাকাতেও তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম তদারকি করছেন।

‘একজন রাজনৈতিক নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো যে কখনোই সমীচিন নয়- আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে জানানোর প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশের মানুষকে আমরা বন্ধুর মতো, ভাইয়ের মতো ভালোবাসি বলেই তাদের এই বার্তাটা দিতে চেয়েছি যে এভাবে কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা যায় না’।

তিনি বলছেন, তুরস্কের ইতিহাসেও একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে আদালতে বিচার করে তারপর ফাঁসিতে ঝোলানোর নজির আছে। কিন্তু আজও আমরা সেই ফাঁসির জন্য অনুশোচনা করি। এভাবে আসলে কোনও সমাধান হয় না।

তুর্কী রাষ্ট্রদূত যার কথা বলছেন, সেই আদনান মেন্দেরিসকে সংবিধান লঙ্ঘন করার অপরাধে তুরস্কের একটি সামরিক আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আজ থেকে ৫৫ বছর আগে।

নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল আল বদরের মতো একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার। যারা যুদ্ধের সময় খুন, ধর্ষণ বা গণহত্যায় লিপ্ত ছিল। নিজামীর বিচারও হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

এটা কি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ একটা বিষয়ে তুরস্কের হস্তক্ষেপ করার সামিল? এ প্রশ্নের জবাবে আকচাপার বলছেন, কোনো একটা জিনিস যদি আমরা মনে করি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী, তাহলে আমাদেরও কিন্তু অধিকার আছে তা প্রকাশ করার।

‘আমরা বাংলাদেশকে বন্ধু বলে মনে করি বলেই কিন্তু আমরা মন খুলে কথা বলছি। যাদেরকে আপনি একই পরিবারের সদস্য বলে মনে করেন, তাদের বেলায় কখনও কখনও কিন্তু চুপ করে থাকার চেয়ে বড় প্রতারণা আর কিছু হয় না।’

বাংলাদেশের মানুষদের একটা বিরাট অংশ বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে এসেছেন- বিশেষ করে যুদ্ধের সময় যারা প্রিয়জনদের হারিয়েছেন, তাদের সেই অন্যায়ের একটা ক্লোসার দেওয়ার অধিকার বাংলাদেশের এই জনগণের থাকার প্রশ্নটাকে তুরস্ক কীভাবে দেখছে এ প্রশ্নের উত্তরে আকচাপার বলেন বাংলাদেশের কী অধিকার আছে না- আছে তা নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে চান না।

‘মৃত্যুদণ্ড এমনিতেই কোনও ভাল সাজা নয়। আর একজন রাজনৈতিক নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো তো কিছুতেই মানা যায় না। তবে প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত অধিকারের নয়। আমাদের মূল কথাটা হল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ কিন্তু বিরাট একটা ভুল করেছে।’

তুর্কী রাষ্ট্রদূত নানা ভাবে তার কথার মধ্যে দিয়ে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে যেসব অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোকে তারা গুরুত্ব দিতে রাজি নন।



মন্তব্য চালু নেই