তিন মাস পর ‘বছর’ শুরু
২০১৫ সাল শুরু হলেও শিক্ষা কার্যক্রমের হিসেবে ‘বছর’ সেভাবে শুরু হচ্ছিল না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, কারণ অবরোধ-হরতাল।
লাগাতার অবরোধ-হরতালের মধ্যে রাজধানীতে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু দিন আগে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হলেও অধিকাংশ স্কুলই ছিল কার্যত বন্ধ।
সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের আগে বিএনপির বার্তায় হরতালের ঘোষণা না দেখে রোববার খুলেছে ঢাকার স্কুলগুলো।
পরে বিএনপির নামে এক বিবৃতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রাম হরতালের আওতামুক্ত রাখার ঘোষণা দেখে স্কুলগুলো সোমবার থেকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আর তা দেখে স্বস্তি ফিরেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। বছরের তিন মাস চলে গেলেও শিক্ষা কার্যক্রম সেভাবে শুরু না হওয়ায় সবার মধ্যেই ছিল হতাশা।
মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মনিরুল ইসলাম বলেন, “স্কুল বন্ধ থাকায় আমার মেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিল।”
“যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে; আমি মনে করি, এসব ধংসাত্মক রাজনীতি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দূরে রাখাই ভালো,” বলেন এই ব্যবসায়ী।
গত ৫ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ এবং ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে প্রায় লাগাতার হরতালে সবচেয়ে বেশি বিঘ্নিত হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম।
বিক্ষিপ্ত বোমাবাজি ও গাড়ি পোড়ানোর মধ্যে যান চলাচলের পাশাপাশি অফিস-আদালত সচল থাকলেও শিশুদের ঝুঁকিতে ঠেলে দিয়ে ক্লাস চালু করতে সাহসী হচ্ছিল না স্কুল কর্তৃপক্ষগুলো।
এমনকি হরতালের মধ্যে চলমান এসএসসি ও সমমানের সব পরীক্ষা পেছানো হয়। শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারই পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে।
অবরোধ শুরুর মাস খানেক পর সহিংসতার মাত্রা কমলে রাজধানীর কয়েকটি স্কুল খোলে। তবে অধিকাংশ স্কুলে শুক্র ও শনিবারই ক্লাস নেওয়া হচ্ছিল। রোববার এক যোগে খুলেছে প্রায় সব স্কুল।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সকাল থেকে শিশুদের কলরব দেখা যায়, স্বাভাবিক এই চিত্র রাজনৈতিক কারণে গত তিন মাস ধরে ছিল অনুপস্থিত।
অনেক দিন পর ক্লাস করে বেরিয়ে ধানমণ্ডির নালন্দা বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী জুহায়ের শাহাব মেঘদূত বলে উঠে- “আজ অনেক মজা হয়েছে।”
স্কুল বন্ধ থাকলে ভালো লাগে না বলে জানায় এই শিশুটি, তার সঙ্গে থাকা অন্য শিক্ষার্থীরাও একই সুরে কথা বলে।
আর শিক্ষার্থী না থাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও যে নামমাত্র হয়ে যায়, তা বললেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম।
“কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি বন্ধ থাকে, সেটি মৃত্যুপূরীতে পরিণত হয়, এতদিন পর স্কুলে প্রাণ ফিরে এসেছে।”
মতিঝিলের জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রান্ত মজুমদারের বাবা ব্যাংকার বিজয় মজুমদার শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করার মতো কর্মসূচি নিয়ে অসন্তোষ জানান।
“এত ছোট বয়সে এই বাচ্চাগুলোকে যদি এই বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, তা পরে তাদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।”
ক্লাস শুরু না হওয়ার সমস্যা ফুটে ওঠে বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী চৌধুরী ফাহিম রাগীবের কথায়।
“ক্লাস বন্ধ থাকায় ঠিকমতো পড়াশোনা হয়নি। এখন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে।”
বেশ কিছু দিন বিরতি দিয়ে ক্লাস শুরু হওয়ায় রোববার উপস্থিতি ছিল তুলনামূলকভাবে কম, তবে শিক্ষকরা আশাবাদী, কয়েকদিনের মধ্যে পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে উপস্থিতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার উদয়ন স্কুলের সহকারী শিক্ষক নাসির উদ্দিন বলেন, সব মিলিয়ে রোববার উপস্থিতি ছিল ৩০ শতাংশের মতো। তবে নিচের ক্লাসগুলোতে উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক বেশি।
“তবে ভয় কেটে গেলে কয়েকদিনের মধ্যে উপস্থিতি স্বাভাবিকের মতো হয়ে যাবে,” আশাবাদী তিনি।
বন্ধের এই সময়ে সিলেবাস শেষ করার জন্য কয়েকটি শ্রেণিতে শুক্র ও শনিবার ক্লাস নেওয়া হত বলে জানান মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজেন অধ্যক্ষ শাহান আরা।
“শুক্র ও শনিবার করে পঞ্চম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া হয়েছে। এটি না করলে বোর্ড পরীক্ষার জন্য তারা পিছিয়ে পড়ত। তবে অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কিছুটা পিছিয়ে পড়বে।”
তবে সপ্তাহে ছয় দিনের পরিবর্তে দুদিন ক্লাস নেওয়ায় শিক্ষার্থীদের ঠিকভাবে পড়ানো সম্ভবপর হয়নি বলে স্বীকার করেন উদয়ন স্কুলের সহকারী শিক্ষক নাসির উদ্দিন।
“দেখা গেছে এক দিনে হয়ত ৪-৫টি লেসন সম্বন্ধে তাদের ধারণা দেওয়া হয়েছে, এটা করা হয়েছে শুধু সিলেবাস শেষ করার জন্য। শিক্ষার্থীদের জন্য এটা মোটেই ভালো নয়, কিন্তু আমাদের কোনো উপায়ও ছিল না।”
তবে এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন বলে শিক্ষকরা আশ্বস্ত করেছেন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বলেছেন, ছুটি কমিয়ে, না অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া হবে, তা নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি।
শিক্ষা কার্যক্রম হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখতে বারবার আন্দোলনকারী বিএনপি জোটের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন নাহিদ।
তিনি রোববারও বলেন, “আমরা আর কত বিনয়ী হব, আর কত নত হব? আমি এত চিৎকার করলাম অন্তত পরীক্ষার আগে পরে দুই ঘণ্টা হরতাল দেবেন না। কেউ তা আমলে নেয়নি।
“দয়া করে পরীক্ষায় আর বাধা সৃষ্টি করবেন না। আর সর্বনাশের দিকে যাবেন না, হাত গুটিয়ে নিন।”
মন্তব্য চালু নেই