তামিম নাকি জিয়া: ‘শেখ আদনানি’ কোন জন?
গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার ঈদগাহের হামলাসহ সমসাময়িক জঙ্গি হামলার ঘটনায় দুইজন মাস্টারমাইন্ডকে শনাক্ত করা গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এরা হলেন- তামিম আহমেদ চৌধুরী ও মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ মো. জিয়াউল হক।
পুলিশ জানিয়েছে, এদেরকে ধরিয়ে দিতে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করলে ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে তথ্যদাতার পরিচয় পুরোপুরি গোপন রাখা হবে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তামিম আহমেদ চৌধুরী জেএমবি’র নতুন একটি গ্রুপের ‘মাস্টারমাইন্ড’। সিলেটের বাসিন্দা তামিমই বাংলাদেশের কথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস) প্রধান। আরেকজন সৈয়দ মো. জিয়াউল হক বরখাস্ত হওয়া মেজর। তিনি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) মাস্টারমাইন্ড।
এদিকে, গুলশানের হলি আর্টিজানের হামলার পর গত ৬ জুলাই বাংলাদেশে ফের হামলার হুমকি দিয়ে ভিডিও প্রকাশ করে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা দায়েশ। ভিডিওটি প্রকাশ করেছে বিতর্কিত সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপ। ওই ভিডিওতে তিন তরুণ বাংলায় এবং ইংরেজিতে কথা বলছে। ভিডিওটি কোথায় ধারণ করা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তবে সাইটের ভাষ্য এটি দায়েশের কথিত রাজধানী সিরিয়ার রাকা থেকে প্রকাশ করা হয়েছে। কোনো একটি ব্যস্ততম রাস্তায় ধারণ করা ভিডিওতে প্রায় এক তরুণ বাংলা ও ইংরেজিতে বক্তব্যে বলেন, গুলশানের হামলা ছিল ঝলক মাত্র। এমন ঘটনা আরো ঘটবে।
ভিডিওতে এক তরুণকে বলতে শোনা যায়, ‘শেখ আদনানির’ নির্দেশে তারা ‘খ্রিস্টান, ইহুদি ক্রসেডার ও তাদের মিত্রদের’ বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ করছে এবং তা কোনোভাবেই ‘কৌতুক নয়’। তারা শেখ আদনানিকে তাদের নেতা এবং গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলাকারীদের তাদেরই দলের সদস্য বলে দাবি করেছে।
এ সকল বিপথগামী যুবক-তরুণদের নেতা আসলে কে? কার নির্দেশে তারা হত্যাকাণ্ডসহ সহিংস কর্মকাণ্ড করছে? তদন্তে পুলিশ বলছে তামিম ও জিয়াউল এ সকল ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং তারাই ‘মাস্টারমাইন্ড’। তাহলে তামিম অথবা জিয়াউলই কি ‘শেখ আদনানি’? ‘শেখ আদনানি’ কি তাদের কারো সাংগঠনিক নাম? গোয়েন্দারাও এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে তদন্ত করছেন।
অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ওই হামলায় জড়িতরা বাংলাদেশের বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্য।
ওই ভিডিও’র তিন তরুণের মধ্যে প্রথম তরুণের পরিচিতজন ও বন্ধুরা জানিয়েছে, সে সাবেক নির্বাচন কমিশনার সফিউর রহমানের ছেলে তাহমিদ রহমান শাফি। রাজধানীর উত্তরা এলাকায় তার বাড়ি। তাদের গ্রামের বাড়ি সিলেট। ২০১৪ সালের ১৮ আগস্ট ৭৫ বছর বয়সে তাহমিদের বাবা সফিউর রহমান মারা যান। বাংলাদেশের বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণফোনে চাকরি করেছে। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত সঙ্গীত বিষয়ক রিয়েলিটি-শো ‘ক্লোজআপ ওয়ানের’ প্রথম সিজনের মাধ্যমে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল তার। ক্লোজআপ ওয়ানে তার গাওয়া ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ এ গানটি সেইসময় শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়। সেই গানটির ভিডিও ইউটিউবে এখনও রয়েছে। তাহমিদ নটরডেম কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেছেন। এর পর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে পড়েছেন। বছর খানেক ধরে পরিচিতজন ও বন্ধুদের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ নেই। তাহমিদ নিজেও গান লিখতো ও সুর করত। তবে গত কয়েক বছর ধরে সংগীতাঙ্গনের কেউই তাকে গান গাইতে বা অ্যালবাম বের করতে দেখেননি।
ভিডিও’র দ্বিতীয় তরুণের মুখমণ্ডল ঢাকা থাকলেও গলার শব্দ শুনে তার পরিচিত ও বন্ধুরা বলছেন, তার নাম তৌসিফ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি আইবিএ বিভাগে পড়ালেখা করতেন। জেএমবি সম্পৃক্ততার অভিযোগে আগে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। এ ঘটনার পর তার পরিবার তাকে অস্ট্রিয়া পাঠিয়ে দিলেও সেখানে এখন সে নেই।
ভিডিও’র তৃতীয় তরুণকে বাংলাদেশের মডেল নায়লা নাঈমের সাবেক স্বামী তুষার বলে তার পরিচিতজন ও বন্ধুরা দাবি করেছে। তার বাবার নাম মেজর ওয়াশিকুর আজাদ। রাজধানীর বারিধারা এলাকায় তারা থাকতেন। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি এবং রাজউক থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি একজন ডেন্টিস্ট ছিলেন। দুবছর আগে হঠাৎ করেই তিনি নিখোঁজ হন।
তামিম ও মেজর (বরখাস্ত) জিয়াউল প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহিদুল হক বলেন, আমরা মাস্টারমাইন্ডদেরকে শনাক্ত করতে পেরেছি। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে পারলে তাদের দ্বিতীয় কমান্ডার বা ৩য় কমান্ডারকে শনাক্ত করা সম্ভব হবে। তাদের ধরতে পারলে বর্তমানের এই জঙ্গি তৎপরতা কমানো সম্ভব হবে। সিলেটের বাসিন্দা তামিমই বাংলাদেশের তথাকথিত আইএস প্রধান। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তামিম আহমেদ চৌধুরী জেএমবির নতুন একটি গ্রুপের ‘মাস্টারমাইন্ড’। এছাড়া বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ মো. জিয়াউল হক আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মাস্টারমাইন্ড।
তিনি আরও বলেন, গুলশান হামলার সময় তামিম বাংলাদেশেই ছিলেন। হামলার আগে জঙ্গিদেরকে তামিম ব্রিফ করেছিল বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। তবে তারা এখন দেশে আছে নাকি বিদেশে এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত না। আমরা তামিম ও জিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।
সেনাবাহিনীতে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান-চেষ্টার পরই ২০১২ সালে প্রথম আলোচনায় আসেন মেজর (চাকরীচ্যুত) সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক। অভ্যুত্থান-চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর থেকেই জিয়ার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। জিয়াকে ধরতে ওই সময় পটুয়াখালী শহরের সবুজবাগ এলাকায় তার শ্বশুর মোখলেছুর রহমানের বাসায় দফায় দফায় অভিযান চালায় পুলিশ। রাজধানীর কয়েকটি স্থানেও জিয়ার খোঁজে চলে অভিযান। কিন্তু আজও জিয়া রয়েছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মেজর জিয়ার শাশুড়ী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা হামিদা বেগম।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সৈয়দ জিয়াউলের পরিকল্পনায় একাধিক ব্লগার, লেখক, ভিন্ন মতালম্বী ও ধর্মালম্বী খুন হন। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থাতেই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সৈয়দ জিয়াউল। ২০১১ সালে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে অভ্যূত্থানের চেষ্টা করেন তিনি। ওই বছর ১১ ডিসেম্বর এ ব্যর্থ অভ্যূত্থানের চেষ্টা করা হয়। ঊর্ধ্বতন সেনাকর্মকর্তারা তার অভ্যূত্থান চেষ্টা ভেস্তে দেন। এরপর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সেনাসদর থেকে এ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সে সময় জিয়ার ছুটি ও বদলি আদেশ বাতিল করে তাকে শিগগিরই ঢাকার লগ এরিয়া সদর দফতরে যোগ দিতে বলা হয়। বিষয়টি টেলিফোনে ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর তাকে জানানো হলেও তিনি পলাতক থাকেন।
গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, আত্মগোপনে থেকে জিয়াউল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা শাইখ জসিমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ধীরে ধীরে এবিটির শীর্ষপর্যায়ের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। জিয়াউল হক ছিলেন সেনাবাহিনীরও একজন চৌকস অফিসার। কমান্ডো ট্রেনিং রয়েছে তার।
অভ্যুত্থানের অন্যতম পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়াউল হক তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়েও বেশ পারদর্শী ছিলেন। তাই সবার সঙ্গে মেইল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে যোগাযোগ করতে তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এমনকি বিদেশে যেসব প্রবাসী এ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ করতেন জিয়াউল। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে বিদেশে বসবাসরত বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিরা জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের অনেকের সঙ্গে মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের যোগাযোগ ছিল।
মেজর জিয়াউল হকের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নে। মেজর জিয়া এক সময় বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার ৯ নম্বর সড়কের ৫১২ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকতেন। তার বাবার নাম সৈয়দ জিল্লুর হক। তিনি সত্তরের দশকে চাকরি নিয়ে সৌদি আরবে যান। তার বাবা দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সৌদি আরবে অবস্থান করেন। জিয়া দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। তার পাসপোর্ট নম্বর— এক্স-০৬১৪৯২৩।
জিয়াউল হক প্রথমে বিয়ে করেন তার মামা বিচারপতি মইনুল হকের মেয়ে লিপিকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৭ সালে প্রথম স্ত্রী মারা গেলে তিনি পটুয়াখালীর মোখলেছুর রহমানের ছোট মেয়ে সাফা জোহরাকে বিয়ে করেন। তার শ্বশুর পটুয়াখালী শহরের আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শাশুড়ি হামিদা বেগম পটুয়াখালী শহরের শেরেবাংলা বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষিকা।
তামিম আহমেদ চৌধুরীর বাবার নাম শফিক আহমেদ চৌধুরী এবং মা খালেদা শফি চৌধুরী। তার স্থায়ী ঠিকানা সিলেটের বিয়ানি বাজার থানার দোবাক ইউনিয়নের বড়গ্রাম সাদিমাপুর। তামিমের বর্তমান পাসপোর্ট নম্বর এএফ-২৮৩৭০৭৬ ও পুরান পাসপোর্ট নম্বর এল-০৬৩৩৪৭৮। তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর- ১৯৮৬০০৯১২৪১০০১৩৪২। ১৯৮৬ সালের ২৫ জুলাই তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তামিম সর্বশেষ ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর দুবাই থেকে ইত্তেহাত এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফিরে আসেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদুর রহমান দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তামিম ও মেজর (বরখাস্ত) জিয়াউল হলো জেএমবি ও এবিটির নেতা এবং সাম্প্রতিক ওই সকল ঘটনার ‘মাস্টারমাইন্ড’। তাদের আইনের আওতায় আনলে বিস্তারিত জানানো যাবে। এ জন্য পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করছে। -দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই