তনু হত্যার ঘটনায় একজন আটক!

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন এক যুবককে আটক করার খবর পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ডের চার দিন পরও পুলিশ এ মামলায় কোনো অগ্রগতি দেখাতে না পারলেও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ওই যুবক আটক আছে। নিহত তনুর পরিবারিক সূত্রে জানা গেছে, পিয়ার নামের এক যুবক তনুকে উত্ত্যক্ত করত। তবে আটক যুবকটি পিয়ার কি না তা সূত্রগুলো নিশ্চিত করতে পারেনি। পুলিশ দাবি করছে, তারা পিয়ার নামে যুবকের বিষয়ে কিছু জানে না।

অন্যদিকে কুমিল্লা সেনানিবাসে সংঘটিত তনু হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকাসহ দেশের আরো অনেক এলাকায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে প্রতিবাদী মানুষ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এসব প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকারকর্মী এবং সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অসংখ্য মানুষ তনু হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। কুমিল্লায় গতকাল তৃতীয় দিনের মতো সড়ক অবরোধসহ ব্যাপক বিক্ষোভ করেছে ভিক্টোরিয়া কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ।

একজন আটকের খবর : তনুর পারিবারিক সূত্র জানায়, পিয়ার নামে একটি যুবক তনুকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। সে কুমিল্লা সেনানিবাসে পরিবারের সঙ্গে থাকে। প্রাইভেট পড়াতে যাওয়ার সময় পিয়ার তাকে উত্ত্যক্ত করত। জানা গেছে, পিয়ার ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া তনুর ফেসবুক আইডি সূত্রে জানা গেছে, একটি মোবাইল ফোন নম্বর থেকে তনুকে বিরক্ত করত অপরিচিত এক যুবক।

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, তনু হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকায় এক যুবককে আটক করা হয়েছে। তবে সে যুবকটি পিয়ার কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কুমিল্লার পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন কাউকে আটক বা গ্রেপ্তারের কথা অস্বীকার করেছেন।

সূত্র জানায়, তনু হত্যার পরদিন গত সোমবার এক যুবককে আটক করে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর থেকে ওই যুবকের আর কোনো খোঁজ নেই। তবে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।

এদিকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা আইনশৃঙ্খলা কোরের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল, পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন, ডিজিএফআইয়ের ডিজি সাজ্জাদ হোসেন, বিজিবির কমান্ডার লে. কর্নেল মোখলেসুর রহমান, র‌্যাব-১১-এর ক্রাইম প্রিভেনশন কম্পানির কমান্ডার, এনএসআইয়ের জেনারেল ডিরেক্টর মজিবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক হাসানুজ্জামান কল্লোল সবার সহযোগিতা কামনা করে বলেন, ‘তনু হত্যার বিষয়ে কারো কাছে কোনো তথ্য থাকলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো দরকার। আমরা সবার সহযোগিতা চাই।’ এ সময় পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন জানান, তনু হত্যার বিষয়ে এখনো পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমকে দেওয়ার মতো কোনো তথ্য নেই। তিনি বলেন, ‘নিহত তনুকে ফোনে কেউ বিরক্ত করত বলে তাঁর ফেসবুকে যে নম্বর আছে সে সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া পিয়ার নামের কেউ তাঁকে বিরক্ত করত এমন তথ্যও আমাদের জানা নেই। তাঁর পরিবার আমাদের কিছু জানায়নি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লা সেনানিবাসের ৫৮/১ পাহাড় হাউসে বসবাস করা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাসের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুর সঙ্গে সবার সুসম্পর্ক ছিল। ছোট থেকে তিনি বড় হন কুমিল্লা সেনানিবাসেই। সেনানিবাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যোগ দিতেন তিনি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁকে ভালো জানত। ভিক্টোরিয়া কলেজের সবাই তাঁকে পছন্দ করত। তনুর সঙ্গে একই বাড়িতে থাকত তাঁর সমবয়সী চাচাতো বোন নাইজু জাহান। তনুর দীর্ঘদিনের সঙ্গী নাইজু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থী।

নাইজু কালের কণ্ঠ বলেন, ‘সে (তনু) রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কারো দিকে তাকাত না। আমরা তার ঘটনা শুনে বিস্মিত। কারণ আমরা সেনানিবাসে থাকতাম। আমরা এমন কিছু দেখিনি। কিন্তু হঠাৎ এটা কী হলো, কিভাবে হলো, আমরা বুঝতে পারছি না।’ নাইজু জাহান আরো বলেন, “পিয়ার নামে এক ছেলে তাকে বিরক্ত করত। সে পড়াশোনা করে এবং সেনানিবাসেই থাকে। প্রাইভেট পড়াতে যাওয়ার সময় সে প্রায়ই তনুকে বিরক্ত করত। তনু নিজে আমাকে এ কথা বলেছে। একদিন সে রাস্তায় পিয়ারকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘এই ছেলেটিই আমাকে ডিস্টার্ব করে’।” তবে পিয়ার সম্পর্কে নাইজু বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেননি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে যে তথ্য বের হয়েছে, এর প্রতিবাদ করেন নাইজু। তিনি বলেন, লাশ দেখে তাঁদের মনে হয়নি তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে তনুকে উত্ত্যক্তকারী যুবক পিয়ারের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১টায় ৭১ টিভির সরাসরি সম্প্রচারিত টক শোতে কুমিল্লার পুলিশ সুপারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। টক শোতে অংশ নেন কালের কণ্ঠ’র নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কাশেম হৃদয়ও। সন্দেহভাজন যুবক পিয়ার সম্পর্কে হৃদয় জানতে চাইলে পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন টক শোতে বলেন, পুলিশ পিয়ার সম্পর্কে কিছু জানে না। ওই টক শোতে আরো উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক শ্যামল দত্ত ও কাজী সিরাজ। ওই সময় তনু হত্যার কোনো ক্লু পাওয়া গেছে কি না আবুল কাশেম হৃদয়ের এই প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘এই মামলায় হাইলি কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপার আছে। এটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু বলতে পারছি না।’

ঢাকায় প্রতিবাদ : তনু হত্যার ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে গতকাল শাহবাগে গণসমাবেশ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। সমাবেশে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেছেন, ‘তনু হত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগেই রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে। এ দেশে একটি ঘটনা চাপা দিতে নতুন আরেকটি ঘটনার জন্ম দেওয়া হয়। তনুকে ধর্ষণের ঘটনা কি রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে চাপা দিতে? এ দেশে চোরের বিচার হয়, ডাকাতের বিচার হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ধর্ষকের বিচার হতে দেখলাম না। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যারা ধর্ষণ করে তারা কতটা ক্ষমতাবান।’

তনুকে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গণজাগরণ মঞ্চের স্বাধীনতা কনসার্ট প্রত্যাহার করেছে সংগঠনটি। গণসমাবেশে আরো বক্তব্য দেন মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহসাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি লাকী আক্তার, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রান্টের সভাপতি ইমরান হাবীব রুমন ও ভাস্করা রাশা প্রমুখ।

একই দাবিতে গতকাল বিকেলে প্রতিবাদী মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে নারী সংহতি। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এ কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন নারী সংহতির সভাপতি শ্যামলী শীল, সহসভাপতি তাসলিমা আখতার, সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা দেব, সহ-সাধারণ সম্পাদক রেবেকা নীলা, সাংগঠনিক সম্পাদক জান্নাতুল মরিয়ম প্রমুখ।

কুমিল্লা ও অন্যান্য স্থানে প্রতিবাদ : গতকাল বিকেল ৩টা থেকে কুমিল্লা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে ব্যারিকেড দিয়ে বিক্ষোভ করে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীসহ হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। এ সময় তনু হত্যার বিচারের দাবিতে মুখরিত ছিল কুমিল্লার প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরসহ আশপাশের এলাকা। তারা তনুর হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানায়। সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ চলাকালীন বিপুল পরিমাণ পুলিশকে বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

গতকাল জুমার নামাজের পর সহপাঠীরা মিছিল নিয়ে নগরীর কান্দিরপাড়ে এসে জমা হয়। তনু হত্যার বিচারের দাবিতে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে কান্দিরপাড় এলাকা। শিক্ষার্থীরা ব্যানার, প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার হাতে তনু হত্যার বিচারের দাবিতে একাত্মতা প্রকাশ করে। এ সময় তারা সড়কের ওপর ড্রাম ফেলে, শুয়ে-বসে অবস্থান নেয়। এতে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী উভয় দিকের যান চলাচল বন্ধ থাকে।

তনু হত্যার বিচার দাবিতে সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুরে মানববন্ধন তৈরি করা হয়। গতকাল দুপুরে এনায়েতপুর থানার কেজি মোড়ে এনায়েতপুর ছাত্র ফোরামের আয়োজনে এ কর্মসূচি পালিত হয়। মানববন্ধন তৈরি করা হয় নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। জেলা ছাত্র ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট যৌথভাবে এ কর্মসূচির আয়োজন করে। ফরিদপুর শহরে সংস্কৃতিকর্মীরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে ও হাতে পোস্টার নিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শহীদ সাটু হলের সামনে ‘প্রতিবাদ করুন, বাঁচবে হাজারো তনু…ঝরে যাবে না অপ্রস্ফুটিত ফুল’ স্লোগান নিয়ে সাধারণ ছাত্র সমাজের ব্যানারে মানববন্ধন তৈরি করা হয়। মণিরামপুর পৌর শহরের উপজেলা পরিষদ চত্ব্বরে গতকাল মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়।

সেনাবাহিনীর বক্তব্য : এদিকে গত রাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সোহাগী হত্যার কারণ উদ্ঘাটনে সেনাবাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গত ২০ মার্চ তারিখ রাত আনুমানিক ১১টায় কুমিল্লা সেনানিবাসের সীমানাসংলগ্ন এলাকায় (এ স্থানে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই) সোহাগী জাহান তনুর অচেতন দেহ খুঁজে পান তাঁর বাবা ইয়ার আলী। তিনি মিলিটারি পুলিশকে খবর দেন। তৎক্ষণাৎ সোহাগীকে সিএমএইচে নেওয়া হয় এবং সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ মাধ্যমে তাঁর ময়নাতদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। সোহাগী হত্যার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং সেনাবাহিনী সোহাগী হত্যার কারণ উদ্ঘাটনে পুলিশ ও প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করছে।’ সূত্র: কালেরকণ্ঠ।



মন্তব্য চালু নেই