স্বপ্ন জয়ে নড়াইল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে

ড. রথীন্দ্রনাথ বোস: স্বপ্নকে সম্ভব করেছিলেন যিনি

নড়াইল শহরে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলরের (গবেষণা) মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রাণরসায়নের এই অধ্যাপকের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটি ওষুধ। কেমোথেরাপির বিষাক্ত প্রভাব কমিয়ে আনতে একটি নতুন ওষুধ আবিষ্কারে তার ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজি ট্রান্সফার বিষয়ক ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সম্প্রতি চির বিদায় নিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণার জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাওয়া ড. রথীন্দ্রনাথ বোসকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন তারই ভাতিজা বেয়ার ফার্মাসিউটিকেলসের গ্লোবাল ক্লিনিকেল ডেভেলপমেন্টস অপারেশনস বিভাগের হেড অব ইমপ্রুভমেন্টস ড. সুব্রত বোস।

ড. রথীন্দ্রনাথ বোসের জন্ম নড়াইলে। শৈশব কৈশোরও কেটেছে নড়াইলে; সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ, তারপর রসায়নে অনার্স-মাস্টার্স রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম দুটোতেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দিন শিক্ষাকতা করেছেন রসায়ন বিভাগে। তারপর উচ্চ শিক্ষার জন্য যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখান থেকে পিএইচডি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু দিন পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চের পর বিশ্ববিদ্যায়ে শিক্ষকতা- এরকম ক্যারিয়ার বিরল কিছু নয়- অনেক বাঙালি এরকম ক্যারিয়ার গড়েছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকাতে।

রথীন্দ্রনাথ বোস এখানেই থেমে থাকেননি। ব্যতিক্রম এখানেই বাংলাদেশের ছোট্ট শহরের বেড়ে ওঠা এই মানুষটি অদম্য মেধা, প্রতিভা আর কঠোর পরিশ্রমে আমেরিকার একাডেমিক এবং গবেষণা জগতে গুরুত্বপূর্ণ একজনে পরিণত হয়েছিলেন।

গবেষণার শুরুটা ছিল সলিড টিউমারকে ঘায়েল করতে পান্টিনামের ব্যবহার দিয়ে। এক নয়, একাধিক ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, যার অনেকগুলোর এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। তার গবেষণার পরিধি বিস্তৃত ছিল ফুয়েল সেল থেকে স্ট্রাকচারাল বায়োলজি পর্যন্ত। অনেকগুলো গবেষণা গ্রন্থ বেরিয়েছে। আছে একাধিক পেটেন্ট। গবেষণা করে সফলতা পাওয়া এবং সেইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার নজির বেশ দুর্লভ।

আমেরিকার প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাইস চ্যান্সেলর পদে তাকে পাওয়ার জন্য অনেকটা প্রতিযোগিতা শুরু করে। গত ১৫ বছরে কেন্ট স্টেইট ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইলিনয়, ওহাইয়ো বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ টেক্সসের ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টনে ভাইস চ্যান্সেলরের (গবেষণা) দায়িত্ব পালন করেছন। গত শুক্রবার ৬৩ বছর বয়সে হিউস্টনে মারা যান ড. বোস।

কেন্ট থেকে হিউস্টন যেখানে গেছেন বদলে দিয়েছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার কাঠামো। আমেরিকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চলে তুমুল প্রতিযোগিতা চলে গবেষণার বরাদ্দের অর্থ পাওয়ার জন্য। এই অর্থ আসে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি দাতব্য এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে। এই অর্থই বদলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পরিকাঠামো।

রিসার্চ ফান্ডিং মানেই নতুন গবেষণা, সারা বিশ্বের মেধাবী মুখের প্রতিযোগিতা। গবেষণার ফল বদলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং। গবেষণালব্ধ মেধাসত্ত্ব বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বছরের পর বছর আয় করে মিলিয়ন ডলার।

ড. বোস হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগ দেন ২০১১ সালে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বাবদ বাজেট ছিল ৯২ মিলিয়ন ডলার। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বাজেট বেড়ে দাঁড়ায় ১৪০ মিলিয়ন ডলারের উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এর পুরো কৃতিত্ব দিয়েছেন এই বাঙালিকে। বিশ্বদ্যিালয়ের শোক বার্তায় ড. বোসের প্রশংসা করেড. কাটরি বলেছেন, শুধু সংখ্যার বিচার দিয়ে তার নেতৃত্বকে মাপা ঠিক হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান ও পরিধি তিনি বদলে দিয়েছেন তার বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনী ধারণা দিয়ে।

কৈশোরে অর্থ কষ্ট দেখেছেন। নড়াইলে তার বাবা পৈত্রিক বিশাল সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল। তাই কোনো বাধাই তাকে দমাতে পারেনি।

আমার মতো অসংখ্য বিজ্ঞান সাধকের রোল মডেল তিনি। আমার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক থাকায় কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল এই বিনয়ী মানুষটিকে। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম হিউস্টনে তখন বলেছেন তার স্বপ্নের কথা, সংগ্রামের কথা।

আমার বাবা ড. বোসের বড় ভাই। মে মাসে আমাকে বলেছিলেন দুভাইয়ের অজানা সব সংগ্রামের কথা। একটা সময় দুই ভাই এক জামা আর এক প্যান্ট ভাগ করে পরতেন।

তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমার বাবা তখন খুলনায় একটা স্কুলে পড়াতেন। বেতনের সামান্য টাকার একটা অংশ যেত তার কাছে। ৪০ বছর আগের এই কথা আমাকে যখন বলছিলেন আমার তখন মনে হচ্ছিল ঘটনাটা কালকের। অতীতকে কখনো ভোলেননি। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শক্তি নিয়েছেন, দৃঢ় করেছেন সংকল্প। বার বার বলতেন, ‘স্বপ্ন দেখিস বাবা। সব সম্ভব।’

সব সম্ভব- আমিও বিশ্বাস করি। নড়াইল থেকে নর্দান ইলিনয়; প্রত্যয় থাকলে দূরত্ব কোনো বাধা নয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাঙালি বিজ্ঞান সাধকেরা প্রেরণা নেবে ড. রথীন্দ্রনাথ বোসের কাছ থেকে।



মন্তব্য চালু নেই