ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে দোটানায় বিএনপি
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ভুল করেছে কি না তা এখন ঘুরপাক খাচ্ছে দলের কর্মী-সমর্থক এমনকি নেতাদের কাছে। নেতারা কারো কারো কাছে স্বীকারও করেছে যে, ওই নির্বাচন নিয়ে তাদের মূল্যায়ন ছিল ভুল। তাদের ধারণা ছিল দেশি-বিদেশি চাপের কারণে সরকার নির্বাচন করতে পারবে না, আর পারলেও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটের পর যেভাবে দু সপ্তাহের কম সময়ে পতন হয়েছিল বিএনপির, একই দশা হবে আওয়ামী লীগেরও।
কিন্তু ভোটের পর গত প্রায় এক বছরে আওয়ামী লীগ স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সহসা ক্ষমতা ছাড়ছে না তারা। তাছাড়া বিএনপির আন্দোলন করে কিছু করার ক্ষমতা আছে কি না তা এখন বড় প্রশ্ন কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। এর মধ্যে দু-দুবার ঈদের পর আন্দোলনের ঘোষণা নিয়ে পিছিয়ে এসে আরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে বিএনপি। দলের নেতারা অবশ্য বলে যাচ্ছেন, তাদের আন্দোলন চলছে এবং এটা চলমান প্রক্রিয়া। তারা এও বলছেন, আন্দোলন মানে কেবল কর্মসূচি নয়, গণসংযোগও এর অংশ। আর নানা প্রক্রিয়ায় জনগণকে একাট্টা করার চেষ্টা চলছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন ৫ জানুয়ারি সারা দেশে ব্যাপকভাবে নামার পরিকল্পনা করছে বিএনপি। আর এই দিনটিকে ঘিরে দলকে একাট্টা করে নানামুখী কর্মসূচিতে যেতে চায় তারা। এর মধ্যে হঠাৎ উঠল ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা। দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা নির্বাচন এই শীতেই করা যায় কি না মন্ত্রিসভার বৈঠকে সে বিষয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এই বক্তব্যের পর বিএনপি পড়েছে দোটানায়। নির্বাচন না আন্দোলনÑকোনদিকে যাবেন তারা বুঝতে পারছেন না ।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিন অবশ্য তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি যাতে আন্দোলন করতে না পারে সে জন্যই সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু এ করে সরকার আন্দোলন আটকে রাখতে পারবে না।
মির্জা ফখরুল তাৎক্ষণিকভাবে এমন বক্তব্য দিলেও বিএনপি নেতাদের একটি বড় অংশই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। তারা মনে করছে, রাজধানীতে সরকারি দলকে একতরফা ছেড়ে দেওয়ার মানে হয় না। তাছাড়া এই ভোটে জিততে পারলে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হবে বলেও মনে করছেন তারা। গত উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির জন্য লাভ হয়েছে বলেই মনে করেন এই নেতারা।
উপজেলা নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপে বিএনপি এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বেশি জিতেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা। কিন্তু শেষ ধাপগুলোতে উঠে কারচুপি, ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ। আর বিএনপি তখন বলতে থাকে, দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তার প্রমাণ এই উপজেলা নির্বাচন।
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে নানা ঘটনা চাপা পড়ে গেছে বলে মনে করছেন বিএনপির উপরোক্ত মত পোষণকারী নেতারা। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলে আর সরকার কারচুপির চেষ্টা করলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবির পক্ষে জনমত গঠন করা সহজ হবে বলেই মনে করেন এই নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মনে করেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সরকার যা করেছে দেশের মানুষ তা মোটেও ভুলে যায়নি। তিনি বলেন, ‘জনগণ সময় হলে ঠিকই জবাব দেবে। নিরব ব্যালটে জনগণ জবাব দেয়। সরকারের ভয় সেখানেই। যে কারণে ভোট না করেই নিজের নির্বাচিত বলে চালিয়ে দিয়েছে।’
রাজধানীবাসী সর্বশেষ নগরপিতা নির্বাচন করেছিল ২০০২ সালের ২৭ এপ্রিল। সে নির্বাচন অবশ্য বর্জন করেছিল আওয়ামী লীগ। আর বলতে গেলে একতরফাভাবে নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা।
পাঁচ বছর পর ২০০৭ সালের ১৪ মে মেয়াদ শেষ হলেও সিটি করপোরেশন নির্বাচন আটকে যায় সীমানাসংক্রান্ত জটিলতায়। আর দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকেন বিএনপি নেতা খোকা।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর ৫৬টি ওয়ার্ড নিয়ে দক্ষিণ এবং ৩৪টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। তখন বলা হয়েছিল, সিটি করপোরেশন ভাগ করার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। ততদিন দায়িত্ব পালন করবেন প্রশাসক। কিন্তু সেটা করা সম্ভব না হওয়ায় প্রশাসকের মেয়াদ বাড়ানো হয় ১৮০ দিন। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর হাইকোর্টের একটি রিটে আবার আটকে যায় নির্বাচন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সীমানাসংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করা কঠিন হবে না বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন। আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন কখন হবে, তা নির্ধারণ করবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আর সীমানা নির্ধারণের দায়িত্বও তাদের। আর সরকারপ্রধান যদি নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেন, তাহলে এই জটিলতা নিরসন কোনো ব্যাপার হবে না বলে মন্তব্য করেছেন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
তবে নির্বাচন কমিশন বলছে, জটিলতার দ্রুত অবসান হলেও জানুয়ারিতে নির্বাচন করা সম্ভব নয় তাদের পক্ষে। নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগ সীমানা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধপত্র পাঠালে কমিশন নির্বাচনের আয়োজন করবে।’
নির্বাচন কবে হবে বা সরকার আদৌ এখন সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার অবসান করতে চায় কি না, সে সংশয়ও কাটেনি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে এ বিষয়ে বিএনপির সন্দেহ রয়েছে। কারণ ক্ষমতাসীন দলের অপকৌশল, জনগণকে বিভ্রান্ত ও আন্দোলন দমনের লক্ষেই ডিসিসি নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে।’
মাহবুবুর রহমান এ কথা বললেও ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বিএনপির জন্য তৈরি করেছে এক নতুন বিভ্রান্তি। সরকার যদি আসলেই এক কোটি বিশ লাখ মানুষের আবাসভূমি রাজধানীতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় আর বিএনপি তা বর্জন করে আন্দোলনের ঘোষণা দেয়, তাহলে দলের জন্য সেটা সুখকর হবে কি না, তা সহজেই বুঝতে পারছেন নেতারা।
আবার নির্বাচন বর্জন করলে তা প্রতিহতেরও একটি বিষয় থাকে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি তা প্রতিহতের আন্দোলনে গিয়ে সারা দেশে রীতিমতো তা-ব চালিয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তারা। কারণ, তাদের আন্দোলনে ভুক্তভোগী হয়েছিল সাধারণ মানুষ। সারা দেশে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে জনগণকে পাশে পায়নি তারা। আর সরকারও বহির্বিশ্বে প্রচার চালিয়েছে যে, নির্বাচনের পর দেশে ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করেছে তারা।
বিএনপির তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেকেই বলেন, গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি ভুল করেছিল। এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্জন করলেও একই ভুল করবে তারা।
নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা বা নির্বাচন কমিশনের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য আসার আগে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। কারণ, সে ক্ষেত্রে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বার্তা যাবে যে, বিএনপি আসলে এই সরকারের অধীনে আরও একটি নির্বাচনে যেতে আগ্রহী। সে ক্ষেত্রে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি কর্মীদের মধ্যেই প্রশ্নের মুখে পড়বে। নেতারা মনে করছেন, কমিশন তফসিল ঘোষণার পর আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বললে বিএনপির দু কূলই রক্ষা পাবে।
তাছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখনও এ নিয়ে নেতাদের সঙ্গে সরাসরি কোনো আলোচনা করেননি। তার আগেই কোনো অবস্থান জানিয়ে বিপাকে পড়তে চান না কোনো নেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বলেন, ‘নানা ঘটনায় আমাদের দলের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে। সরকারের সঙ্গে যোগসাজশের কথাও প্রচার হয়েছে নানা মহলে। এই পরিস্থিতিতে ডিসিসি নির্বাচন নিয়ে চেয়ারপারসন বা মহাসচিব যা বলবেন তার বাইরে কথা বলা আমাদের জন্য বিব্রতকর হবে।’
জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকার আসলেই ডিসিসি নির্বাচন দেয় কি না সেটাও এক প্রশ্ন। আর নির্বাচন দিলে তাতে অংশ নেবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এখনও। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে আপনাদের জানানো হবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, ‘আন্দোলন দমন করতেই মূলত সরকার ডিসিসি নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন সরকারবিরোধী গণআন্দোলন দমন করা যাবে না। আর ইসি নির্বাচনের ঘোষণা দিলেই বিএনপি তার সিদ্ধান্তের কথা জানাবে। কারণ ইসি বলেছে জানুয়ারিতে তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়। নির্বাচনের জন্য তাদের সময় প্রয়োজন। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনও অনেক সময় আছে।’- সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে
মন্তব্য চালু নেই