ডিম আগে না মুরগি?

ডিম আগে, না মুরগি আগে- এ তর্ক বহুদিনের। তর্কটা এখনও অমীমাংসিত। এ নিয়ে তর্ক চললেও, ডিম আজকের দুনিয়ার খাবারের তালিকায় সবচেয়ে পছন্দের এ বিষয়ে বোধকরি খুব বেশি বিতর্ক নেই। সকালের নাস্তার টেবিলে ডিম থাকবে না এটা ভাবা যায় না। সব পাখিই ডিম দেয়, কিন্তু খাবার ডিম বলতে আমরা সাধারণত বুঝি হাঁস-মুরগির ডিম। পাঠক, এটুকু পড়ার পর এথনও কিন্তু মনের ভেতর শুরুর প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে- আচ্ছা কবে থেকে মানুষ ডিম খাওয়া শুরু করল?

মানুষের মগজে এই বুদ্ধি কে ঢুকিয়েছিল যে, পাখির ডিমও খাদ্য তালিকায় এসে গেল? ইতিহাস মানেই পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া। এ ক্ষেত্রেও আমাদেরকে যেতে হবে বহুবছর পেছনে। মানুষ যখন খাদ্যের খোঁজে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত ঠিক সে সময়ের কথা। তখন মানুষের কোনো সামাজিক জীবন ছিল না। বনে বনে ঘুরে মানুষ ফল পেড়ে খেত গাছ থেকে। আবার পশুপাখি শিকার করেও চিবিয়ে একেবারে কাঁচা মাংস খেয়ে ফেলত। সুতরাং এটা ভাবা অন্যায় হবে না যে,  সে সময় পাখি শিকার করে খাওয়ার সময় পাশে পড়ে থাকা ডিমের দিকে মানুষের নজর যায় এবং খাদ্য হিসেবে  সেটাও মুখে তুলে নেয় সে। হয়তো বা সেটাই ডিম খাওয়ার শুরুর ইতিহাস।

দিন-তারিখবিহীন সেই যুগে তারিখটা হিসেব করে বলা সম্ভব নয়। সেটা ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের ঘটনা। তবে ইতিহাসবিদরা বলেন, ডিম খাওয়ার জন্য মানুষ তখন থেকেই অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই হাঁস-মুরগি পোষা শুরু করে। জানা যায়, হাঁস-মুরগির আদি জন্মস্থান প্রাচীন ভারতবর্ষে। বনে জঙ্গলে ভরা ছিল এক সময়ের ভারতবর্ষ। সেখানে হাঁস-মুরগি অনায়াসে ঘুরে বেড়াত। ধারণা করা হয়, পেটের ক্ষুধায় মাংস খেতে খেতে আমাদের আদি পুরুষরা বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকে। তখনই তারা ডিমের প্রতি আগ্রহবোধ করেন। খাওয়ার পরেই তারা বুঝেছিলেন, আরে এটা তো বেশ সুস্বাদু! এখন এটা স্বীকার করা যায় যে, আদি মানুষেরা গুহার ভেতর তখন থেকেই হাঁস-মুরগি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। বনের হাঁস-মুরগি মূলত তখন হয়ে যায় গৃহপালিত প্রাণী। ধারণা করা হয় ভারতবর্ষ থেকে ডিমওয়ালা পাখিরা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। ভারতের পর চীনের আদি মানবেরা যীশু খ্রিস্টের জন্মেরও সাড়ে তিন হাজার বছর আগে থেকে হাঁস-মুরগি পুষতো।

মজার ব্যাপার হলো, মহাবীর জুলিয়াস সীজার যখন পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপ দখল করেন, তখন সেখানে গিয়ে দেখেন তার আগেও জার্মান, গল এবং ইংল্যান্ড দখল করে আছে তুচ্ছ প্রাণী হাঁস-মুরগিরা। ডিম খেয়ে পরিতৃপ্ত হচ্ছে পুরো ইউরোপ। আমেরিকাতে হাঁস-মুরগির প্রবেশ একটু দেরিতে হয়। সেটা ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযানের পর। সেই সময় হাঁসের চেয়ে মুরগির জনপ্রিয়তাই বেশি ছিল। আজো আমরা দেখি মুরগির চেয়ে এতো বংশ বিস্তার অন্য কোনো পাখি করে না। আজকের বিশ্বে মুরগিই সর্বোচ্চ খাদ্য উৎপাদনকারী প্রাণী। এক পরিসংখ্যান বলে যে, পৃথিবীতে যতগুলো মুরগি আছে তারা প্রতি বছর যে ডিম দেয়, সেই ডিম পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ সপ্তাহে অন্তত ৪টি করে খায়। এবার চলুন জেনে নেই ডিম সম্পর্কীত কিছু বিষয়।

ডিম দেখে যায় চেনা
ডিম আগে না মুরগি আগে এ বিষয়টার সমাধান না হলেও, কোন ডিমে মোরগ, আর কোন ডিমে মুরগি তার ফয়সালা করা সম্ভব। যে ডিমটা অপেক্ষাকৃত লম্বাটে হয় সেটা হবে মোরগ। আর যেটা থেকে মুরগি হবে সেই ডিম দেখতে অপেক্ষাকৃত গোলাকার।
ডিম পাড়ার প্রতিযোগিতা

এ অংশে সাধারণত অংশগ্রহণকারীরা মূলত প্রাণীকূল। প্রতিযোগিতায় শীর্ষে আছে সামুদ্রিক শশা। প্রতি মিনিটে এরা ডিম দেয় ৪০ হাজার। একনাগাড়ে এরা অনেকদিন ডিম দিতে পারে। পরিসংখ্যান বলে এদের একজোড়া মাত্র ৪ মাসে ৪৭ কোটি ৮০ লাখ ডিম পাড়ে। প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় স্থানে আছে সামুদ্রিক অরচিন জাতীয় শামুক। প্রতি মৌসুমে এরা ডিম দেয় ২ কোটি। শেষের সারিতে আছে পাখিরা। এক মৌসুমে পাখিরা ডিম দেয় মাত্র ২টি। তবে অল্প আয়ু নিয়েও একমাত্র আশ্চর্য প্রাণী হলো মাছি। মাছি ১৪ দিনের জীবনে যে পরিমাণ ডিম দেয় তা সংখ্যায় হিসেব করতে গেলে রীতিমত হিমশিম খেতে হবে।

প্রায় ৩ কোটি ডিম তাও আবার একসঙ্গে পাড়তে পারে যে প্রাণী তার নাম সান ফিস। এটা মূলত সাগরের প্রাণী। তবে এই ডিমগুলো থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চা ফোটে না। অর্থাৎ বাচ্চা ডিম ফুটে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আবার অনেক সময় সান ফিস নিজের ডিম নিজেই খেয়ে ফেলে। পাঠক চলুন এবার এক ডিমখোর রাজার কথা শোনা যাক।

ডিমখোর রাজা
১৮২০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন রাজা আবদুল আজিজ। তিনি ছিলেন তুরস্কের শাসনকর্তা। রাজা হিসেবে নিজের শাসনকাজ ভালোভাবে করতে না পারলেও তিনি খ্যাতি এনেছিলেন ডিম খেয়ে। রোজ সকালে নাস্তার টেবিলে ডিম না দেখলে তার মাথা বিগড়ে যেত। স্বাভাবিক শরীরে এতো ডিম খাওয়া শুনলে সত্যিই পিলে চমকে যাওয়ার উপক্রম হয়। জানতে চান, তিনি প্রতিদিন নাস্তায় কয়টা ডিম খেতেন? তাহলে শুনুন, তিনি একবসায় নাস্তায় খেতেন ৬০টি সিদ্ধ ডিম। হ্যাঁ পাঠক, আপনি ভুল পড়েননি।
কী আছে ডিমের মধ্যে?
হাঁস-মুরগির ডিমের অংশ তিনটি। উপরে শক্ত খোসা, মাঝে জলীয় সাদা অংশ এবং ভেতরটা হলদে। সাদা অংশটা মোট অংশের প্রায় ৫৮ ভাগ। ডিমের মধ্যে থাকে ৮৭ ভাগ পানি এবং ১২ ভাগ প্রোটিন। হলদে অংশ ডিমের মোট ওজনের ৩২ ভাগ। এতে থাকে ৪৯ ভাগ পানি, ৩২ ভাগ ফ্যাট ও ১৭ ভাগ প্রোটিন। ডিমের খোসাটা হলো মোট ওজনের শতকরা ১০ ভাগ। ডিমের মধ্যে অ্যামিনো এসিড, খনিজ এবং ভিটামিন- এই তিন রাসায়নিক পদার্থ আছে। এ জন্য ডিম উপাদেয় আমিষ।

তবে আগে ডিম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। জীববিজ্ঞানের আলোকে এর ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে। তবে গণিতের আলোকে এর কিন্তু একটি ব্যাখ্যা আছে। আমরা সকলেই জানি, সব কিছুর শুরু শূন্য থেকে। শেষে গিয়েও কিন্তু সেই শূন্য। আর হ্যাঁ ডিমও কিন্তু শূন্যাকৃতির।

 



মন্তব্য চালু নেই