টয়লেটের কমোডে গুপ্তধন, সবারই বোধহয় মূর্চ্ছা যাওয়ার জোগাড়!

পাড়ার দোকানে তিনি ধারে চাল-ডাল কেনেন৷ পাড়ার অনুষ্ঠানে চাঁদা দেন ২৫ টাকা৷ তা-ও আবার অতি কষ্টে৷ তারই বাড়িতে এক মহিলা রোজ ফুল দিয়ে যান৷ রোজ দশ টাকার ফুল৷ সেই টাকা পেতে বছর পেরিয়ে যায় মহিলার৷

সেই বাড়িতেই ভরদুপুরে যেন আরব্য রজনী৷ পুলিশ গুনে গুনে শেষ করতে পারছে না৷ কোটি কোটি টাকা! ৪০ হাজার টাকার মাইনের হরিপদ কেরানির বাড়িতে আরব বাদশার ধনদৌলত৷ প্রণব অধিকারী অবশ্য কেরানি নন৷ বালি পৌরসভার সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার৷

১৪০ নস্করপাড়ার পাড়া রোডে তার বাড়ির সামনে বড়খেলার মাঠ৷ পেলে বা ম্যারাডোনা এলেও অত লোক হবে না, যত লোক ভিড় করেছেন ওই মাঠে৷ হাড়কিপ্টে লোকটার বাড়িতে এত টাকা কি করে জমা হলো!

যত বেলা বাড়ছে, উদ্ধার হওয়া টাকার অঙ্কও বাড়ছে৷ যেন টাকা উদ্ধারের টি-টোয়েন্টি৷ লোকজন খাওয়া দাওয়া ভুলে গেছেন৷ রাজার ঘরে যে ধন আছে, আমার ঘরে যে তার কানাকড়িও নেই৷

মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে, ওই দেখ, আরো ১ কোটি৷ কোথায় ছিল এত টাকা! প্রণবকে হাতের কাছে পেলে তখনই শুরু হয়ে যেত গণপ্রহার৷ মাঠের ভিড়ে ছিলেন গণেশ অধিকারী৷ এলাকারই মানুষ৷ তার কথায়, লোকটা কারো সঙ্গে মেলামেশা করতো না৷

দেখে কেউ বুঝতেই পারিনি লোকটার এত টাকা৷ কী কাণ্ড! সূত্রের খবর, গভীর রাত পর্যন্ত ১০-১২ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছে৷ সোনাদানা-হিরা-জহরত কিলো সাতেক৷ শেষ পর্যন্ত অঙ্কটা কত হবে, ভেবে উঠতে পারছে না পুলিশ৷ খোঁড়াখুঁড়ি চলছে৷ রজনী তখনো বাকি৷

গপ্পটা আসলে কী?

৪৮ বছরের প্রণবের কাজ পৌরসভার প্ল্যান স্যাংশন করা৷ একতলা থেকে বহুতল-বাড়ি করতে গেলে প্রণবের সই দরকার৷ কাঠের চেয়ারে বসেন৷ কিন্ত্ত প্রণব জানতেন তার আসনটি আসলে সোনায় মোড়া৷

চুপচাপ কাজটা শুধু সেরে যেতে হবে৷ ‘৯৩ সাল থেকে চাকরি করছেন তিনি৷ যা মাইনে পান তাতে কত টাকাই বা জমার কথা! কিন্ত্ত তিনি জমিয়ে ফেলেছেন কাড়ি কাড়ি টাকা৷ কিন্তু কেউ সন্দেহ করেনি৷

করার কথাও নয়৷ কারণ তিনি যে ধারে শুকনো লঙ্কা কেনেন৷ চাঁদা দিতে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের পাঁচ কথা শুনিয়ে পঁচিশ টাকার বেশি কিছুতেই দেন না৷

তবে পুলিশের কাছে খবর ছিল, লোকটা সুবিধার নয়৷ কিন্ত্ত প্রমাণ নেই৷ তাই কিছু করাও যাচ্ছিল না৷

দিন কয়েক আগে এক প্রোমোটার রাজ্য পুলিশের দুর্নীতি দমন শাখায় অভিযোগ করেন, প্ল্যান অনুমোদনের জন্য প্রণববাবু তার কাছে ১০ লাখ টাকা চেয়েছেন৷ লিলুয়া এলাকায় ইদানীং বহুতলের রমরমা৷ আনাচে-কানাচে উঠছে বহুতল৷ আর তাতেই প্রণববাবুর কাঠের চেয়ার সোনার হয়েছে৷ প্রোমোটারের অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার তার বাড়িতে হানা দেয় দুর্নীতি দমন শাখার অফিসাররা৷

প্রণববাবুর দোতলা বাড়ি৷ গ্রিল দিয়ে ঘেরা৷ সামনে একটি সরু গলি৷ দুপুর দেড়টা নাগাদ সেখানে হাজির ছয় অফিসার৷ সাদা পোশাকে৷ প্রণববাবু তখন বাড়িতেই ছিলেন৷ তিনি পুলিশকর্মীদের বলেন, আপনারা কে? তারা বলেন, আমরা পুলিশের লোক৷ আপনার বাড়ি সার্চ করতে এসেছি৷

প্রণববাবু বলেন, আপনারা যে পুলিশের লোক তার প্রমাণ কী? অফিসাররা পরিচয়পত্র দেখান৷ প্রণববাবু বুঝে যান, ঘোর বিপদ৷ তখন তড়িঘড়ি বাড়ির ভেতরে চলে যান৷ পেছনের দরজা দিয়ে সাইকেল নিয়ে সোজা আত্মসমর্পণ করেন মালিপাঁচঘরা থানায়৷

কিছুক্ষণ পর থানার পুলিশই প্রণবকে ধরে নিয়ে আসেন তার বাড়িতে৷ ততক্ষণে তল্লাশি শুরু হয়েছে৷ পুলিশের চোখও কপালে উঠছে৷ প্রণবের স্ত্রী ও মেয়ে তখন বাড়িতেই ছিলেন৷ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছেলে ছিলেন বাড়ির বাইরে৷

প্রথম হানা টয়লেটে৷ সেখানে রয়েছে একটি কমোড৷ দেখেই বোঝা যায়, কোনোদিন ব্যবহার হয়নি৷ প্রণব কমোডটি কিনেছেন টাকা রাখার জন্য৷ পুলিশ কমোডের কভার তুলতেই টাকার বান্ডিল৷ একটা নয়৷ অনেক৷

গুনতে গিয়ে পুলিশের কালঘাম ছুটে যাওয়ার জোগাড়৷ ব্যাঙ্ক থেকে আনা হয় টাকা গোনার যন্ত্র৷ পুলিশের সঙ্গে ছিল স্ক্যানার৷ দেয়াল যদি ফাঁপা থাকে তাহলে স্ক্যানার ধরলেই বিপ আওয়াজ হবে৷

এই দেয়ালে স্ক্যানার ধরা হলো৷ বিপ আওয়াজ৷ ওই দেয়ালে ধরা হলো৷ আবারও বিপ৷ এ ঘরে বিপ, ও ঘরে বিপ৷ যন্ত্র ঠিক আছে তো? দ্বন্দ্বে পুলিশ৷ ছেনি-বাটালি দিয়ে দেয়ালে ঘা দিতেই চিচিং ফাঁক৷ ভেতরে সিমেন্টের তাক৷ আর তাতে রাশি রাশি টাকার বান্ডিল ও সোনার গয়না৷ যেন যখের ধন৷

পুলিশের কাছে ছিল একটা থলে৷ আরো আনা হলো চোদ্দটি থলে৷ দু’টি ট্রাঙ্ক৷ লিলুয়ার প্ল্যান অনুমোদনের কী বিপুল নজরানা! দোতলা বাড়ির উপর-নিচ মিলিয়ে আটটি ঘর৷ সব ঘরেই দেয়ালেই ঘুমিয়ে আছে গুপ্তধন৷

মাঝে মাঝে খবর ফাঁস হচ্ছে বাইরে, অনেক টাকা, অনেক টাকা৷ জনতার ফিসফাস তখন কলরবের চেহারা নিয়েছে৷ এত টাকা৷ পিলপিল করে লোক আসছে৷ বার্তা রটে গেছে দূর মুলুকে৷ একটা ঘরে নাকি লুকিয়ে আছে কোটি কোটি টাকা৷ হাওড়া সিটি পুলিশের এসএপি সৌমিক সেনগুপ্ত দলবল নিয়ে বাড়ির বাইরে পাহারা দিচ্ছেন৷ যাতে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে না পড়ে৷

টাকা গুনতে গিয়ে ক্লান্ত পুলিশ৷ ব্যাঙ্ক থেকে আনা হলো টাকা গোনার আরো যন্ত্র৷ প্রণবের বাড়ি যেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সদর দফতর৷ সোনা ওজন করার জন্য স্যাঁকরা ডাকা হলো৷ এল যন্ত্র৷ সোনাও যে অনেক৷ হিরাও নাকি আছে প্রণবের ফাঁপা দেয়ালে৷

কী করে এল এত টাকা? কেউ কি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি? হাওড়া পৌরসভার মেয়র রথীন চক্রবর্তী ফোনই তুলছেন না৷ বাকিদের মুখেও কুলুপ৷ ইঞ্জিনিয়ারের এমন আজব কারবার দেখে সবারই বোধহয় মূর্চ্ছা যাওয়ার জোগাড়৷ সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া



মন্তব্য চালু নেই