টিএসসিতে নারীদের উপর হামলা !

পহেলা বৈশাখ নামটি শুনলেই মনের ভিতর কিছু কিছু গ্রামীণ চিত্র ভেসে ওঠে। ছোট্ট সময়ে আপনজনদের সাথে মেলায় যায়নি এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। হালখাতা উৎসবের মিষ্টিমুখ ও মেলা থেকে নানা খেলনা ক্রয় করে বাড়ি ফিরত ছোট-বড় অনেকেই। কিন্তু এখনকার মেলা ও বর্ষবরণে ছোটদের চেয়ে বড়দেরই বেশি দেখা যায়। দু’দশক আগের পহেলা বৈশাখের চিত্র ও এখনকার আনুষ্ঠানিকতার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। ইদানীং আবার বৈশাখী উৎসবের সাথে নতুন মাত্রায় যোগ করেছে অশ্লীলতা। এক দিনের বাঙালি ও চেতনাধারী ব্যসায়ীরা যতই বাঙালি সাজতে যাচ্ছে একশ্রেণির মানুষ ততই অমানুষের দলে হারিয়ে যাচ্ছে।

অমানুষ কেন বলছি? বলছি এজন্য যে, মাত্র কয়েক দিন আগে বৈশাখের বিকালে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই অবস্থায় টিএসসি এলাকায় কুরুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি ছাড়াও ভুভুজেলা নামে এক ধরনের বাঁশি বাজিয়ে তরুণীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। যেভাবে নারীদের উপর যৌন-নিপীড়ন চালানো হয়েছে তাতে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের ইতিহাসকে আরেকবার কলঙ্কিত করা হলো। সেই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদেরকে কোনোভাবেই মানুষ বলা যায় না। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় হাজারো মানুষের সামনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় রিকশারোহী দম্পতীকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে নির্যাতন করার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ছেলের সামনে মাকে নিপীড়ন করা হয়েছে। সেই নির্যাতনের বর্ণনা পুলিশের ভাষায় ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’! তবে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়েনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দীর ভাষায় নারীর ব্লাউজ ও পেটিকোট ছিড়ে ফেলা হয়েছে। অন্তত ১৫ জন নারী শারীরিক হয়রানির শিকার হন। লিটন নন্দী তার গায়ের জামা খুলে ভিকটিমকে দিয়ে তার ইজ্জত রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। তার বর্ণনা মতে ‘একজন নারীর পরিহিত শাড়ীর বৃহৎ অংশ খুলে ফেলতে দেখেছেন বলে পুলিশের ঢাকা জোনের কমিশনার মনিরুল ইসলামের উপস্থিতিতে’ এটিএন নিউজ সহ বেশ কিছু মিডিয়াতে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। পাঠকরাও হয়তো একমত হবেন যে, প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলা কিংবা নগ্ন করে ফেলা নিশ্চয়ই পশু চেতনার বহিঃপ্রকাশ।

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাওয়ার যে রীতি চালু হয়েছে এটিও কি বাঙালির সংস্কৃতি? তা যদি না-ই হবে তাহলে লাখ লাখ লোক সেখানে যাওয়ার কী গুরুত্ব আছে? যানজটের এ নগরীতে মানুষেরা মুক্ত বাতাস পেতে চলে যায় চলে যায় ঢাকার আশ পাশে কিংবা গ্রামের বাড়িতে। বিশেষ দিন ও ঈদের ছুটিতে চলে যায় গ্রামাঞ্চলে। সেই যাওয়াটাকে আমরা মাটির টান বলি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সাথে সে মাটির কি সম্পর্ক? যারা সেখানের ছাত্র তারা না হয় সে প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভালোবাসার টানে সেখানে ছুটে যান, কিন্তু বহিরাগতরা সেখানে কেন যান? এক ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় শিক্ষক পরিমল ধরের কথা আমরা ভুলে যাইনি। পরিমলকে ধরা হলেও পরিমল ধরের সাথে যাদের আদর্শিক মিল আছে তাদেরকে আটক করার সংবাদ এখনো পর্যন্ত শোনা যায়নি। আমরা ভুলে যাইনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের ধর্ষণে সেঞ্চুরি উৎসবের কথা। সেই সাথে যোগ হলো টিএসসি এলাকায় নারীকে বিবস্ত্র করার এক ঘৃণ্য ঘটনা। মাত্র কয়েকদিন আগে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হলোÑপ্রশাসন তাদেরকেও চিহ্নিত করতে পারল না। পহেলা বৈশাখের ঘটনার পর প্রায় সপ্তাহ পার হয়ে গেল, সামাজাকি মাধ্যমগুলোতে তুমুল ঝড় উঠল অথচ কেউ গ্রেফতার হলো না। এ ঘটনায় মামলা হলেও নেই অগ্রগতি। দেখবার মতো যেন কেউ নেই। এটা রহস্যময় বলেই মনে হচ্ছে। ঘটনার পাঁচদিন পর তদন্ত কমিটির তিন সদস্য ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তাতেও আমরা আশ্চর্য হই না। আমরা এমন তদন্ত কমিটির কথা প্রায়ই শুনি। অধিকাংশ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কখনোই প্রকাশিতই হয় না। অনেক ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়করা চিহ্নিত হলেও শাস্তি পায় না। যে কারণে বর্ষবরণ উৎসবে যৌন হয়রানির ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

সেদিন পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল ঢাকা মহানগরীর বেশ কিছু স্থানে বিকেল ৫ ঘটিকার পরে সেখানে আর অবস্থান করা যাবে না। কিন্তু সে নির্দেশ কেন বাস্তবায়ন করা হলো না ? তাহলে কি ধরে নেব যে, পুলিশ আইন প্রয়োগ ব্যর্থ। নাকি এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে যেনেই তারা নিষ্ক্রিয় ছিলেন ? পুলিশের ভূমিকা নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। কারণ শুরুতে নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনাকে পুলিশের পক্ষ থেকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলা হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘এখানে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে’ (যুগান্তর, ১৬ এপ্রিল’১৫)। বিশ্বজিৎ দাসের নৃশংস হত্যাকা-কেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম (প্রথম আলো ১১ ডিসে¤॥^র,‘১২)। কেরানীগঞ্জের পরাগ ম-লের অপহরণের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্টমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর (প্রথম আলো,১৩ নভে¤॥^র ২০১২)। গত বছরের (২০১৪) ৪ জানুয়ারি একজন প্রিজাইডিং অফিসার নিহত হয়েছেন, সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে জবাবে জনাব ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ‘পেট্রল বোমা হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা : নাসিম’ (যুগান্তর,২৪ জানুয়ারি’১৫)। ‘বিমানবন্দরে চুরি বিচ্ছিন্ন ঘটনা : রাশেদ খান মেনন’ (যুগান্তর, ২৪ ফেব্রুয়ারি’১৫)। ২০০০ সালে থার্টি ফাস্ট নাইটে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাধন নামের একটি মেয়েকে নির্যাতনের ঘটনাকেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হয়েছিল। বাধনের ঘটনারও বিচার হয়নি। হত্যা, চুরি, ধর্ষণ, বোমা হামলাসহ যা কিছুই ঘটুক না কেন তাকে ‘বিচ্ছিনা ঘটনা’ বলে রাষ্ট্র পক্ষ থেকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। এভাবে দায়সারাভাবে কোনো বক্তব্য দিয়ে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করার কোনো আবশ্যকতা আছে বলে মনে হয় না।

সেখানে নাকি নারী লাঞ্ছনার কোনোও সুষ্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ত্রিশের অধিক টিভি চ্যানেল ও শতশত প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকাসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছবি ও ভিডিও থাকার পরেও সুস্পষ্ট প্রমাণ বলতে তারা কি বোঝাতে চান তা জানা নেই। তবে তাদের সুস্পষ্ট কথার ব্যাখ্যা প্রকাশ করা উচিত। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর উচিত হবে প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এক সময় গৌরবের স্থান ছিল। কিন্তু সেই স্থানগুলোতে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনায় বিতর্কিত হতে চলছে। বিশাল ক্যাম্পাস তাই গোটা এড়িয়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা যায় না এমন অযুহাতের সুযোগ নিয়েই দুর্বত্তরা একের পর অঘটন ঘটিয়ে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন দায়ী করে পুলিশকে আর পুলিশ দায়ী করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। এভাবেই একে অপরে দায়ী করার মধ্য দিয়ে চলে যায় বছরের পর বছর। কিন্তু সমস্যার কোনো উত্তরণ হয় না। তবে দীর্ঘদিন থেকে আমরা দেখছি, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছোট-বড় যতগুলো ঘটনাই ঘটছে তার সাথে সেই সময়ে ক্ষমতায় থাকা দলের ছাত্র সংগঠনের নামগুলোই বারবার উঠে আসছে, কিন্তু কেন? অপরাধীদেরকে প্রশ্রয় দেয়া এবং তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়াই যেন ওইসব ছাত্র নামধারী সংগঠনের কাজ!

নারীদের বস্ত্র হরণের ঘটনায় নারীবাদি সংগঠনগুলোতে তেমন সোচ্চার হতে দেখা যায় না। শাহবাগী নেতাদের কাছ থেকেও আশানুরূপ প্রতিবাদ সমাবেশ করতে দেখা যাচ্ছে না। অথচ তারা আল্লামা আহমদ শফীর বক্তব্য বিকৃত করে উপস্থাপন করতে মরিয়া ছিল। সেই সাথে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল কতিপয় মিডিয়া। অথচ সেসব মিডিয়া ও মিডিয়াকর্মীরা টিএসসির নারীদের যৌন হয়রানির সত্য ঘটনাকে নানা ভাবে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। কখনো বলছে নির্যাতিতরা নারী নয় ওরা হিজড়া। কেউ আবার এ ঘটনার সাথে ইসলামি দলগুলোর কর্মীদের সম্পৃক্ততা আবিষ্কার করছেন। ইসলাম একে অপরকে সম্মান করতে বলেছে। বিশেষ করে নারীদেরকে সম্মান করতে বলেছে। আর সে সম্মানের মাপকাঠি হলো তার চরিত্র। বর্ষবরণ উৎসবকে বিতর্কিত করার মধ্য দিয়ে নারী সমাজ ইতোমধ্যেই হয়তো একটা মেসেজ পেয়েছেন যে তাদের চলাফেরায় পরিবর্তন আনতে হবে, পাশাপাশি মানুষ নামের পশুদের পরিবেশ, সভা-সমাবেশ থেকে দূরে থাকবেন বলে আশা করি।



মন্তব্য চালু নেই