টকশো : ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

দেশে-বিদেশে টিভি টকশো একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এর যাত্রা হয়েছিল ১৯৫১ সালে। আমেরিকান মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জে ফ্রাঙ্কলিন এ টকশো প্রচলন করেছেন বলা জানা যায়। সাধারণ মানুষ প্রায়শই সংসদ অধিবেশনের চেয়ে টকশোকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সরকারিদল- বিরোধীদলের নানা বিষয় উঠে আসে টকশোর মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেত্রীর কাছাকাছি হয়ে যখন কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়না তখন টকশোই এমন অনন্য মাধ্যম, যার দ্বারা কথাগুলো তাদের কাছে পৌছানো যায়। এমনকি দলীয় সিনিয়র নেতা কিংবা সাধারণ কর্মীরাও তাদের নেত্রীর কাছে গিয়ে সঠিক কথা বলতে পারেন না। মাঠ পর্যায় দলের অবস্থান কেমন তা জানতে চাইলে হয়তো সঠিক চিত্র অজানাই থেকে যায়। সে হিসেবেও টকশোর গুরত্ব অত্যধিক। এছাড়া পত্রিকার লেখাগুলো সম্পাদকরা কাট-ছাট করতে পারলেও টকশোতে সে সুযোগ কম। টকারদের কথা কথায় কেউ খুশি হন, আবার কেউ অসন্তোষও হন। যারা অসন্তোষ হন তারা সেই অতিথির উপরে হামলা চালান বলেই মনে হয়। বিগত দিনে যারা নিয়মিত টকশোতে আসতেন, তাদেরকে এখন আর কথা বলতে দেখা যায় না। গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানাযায়, তাদের অনেককেই বিভিন্নভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কারো কারো উপর হামলা করানো হয়েছে। কেউ আবার গ্রেফতার, নির্যাতন, প্রাণনাশের হুমকি শুনতে শুনতে অভ্য¯ত হয়েছেন। কেউ হুমকি খেয়ে থমকে আছেন। কেউ সকল হুমকি উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য কথা বলেই যাচ্ছেন। টকারদেরকে যখন স্বাভাবিক পন্থায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না তখনই বেছে নেয়া হয়েছে আইনের মারপ্যাচ।

টকশোতে কে না আসেন ? রাজনীতিবীদ, অবসর প্রাপ্ত আমলা, এনজিও কর্মী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্টসহ লেবাসধারী আলেমের সংখ্যাও কম নয়। তবে জামায়াত ইসলামির কোন নেতা-কর্মী বা জামায়াতের পক্ষ নিয়ে টকশোতে কথা বলেন এমনটি কাউকে দেখা যায়না। টকশো জনপ্রিয হলেও কোন একটি মহল এর নিয়মিত বিরোধীতা করে যাচ্ছেন। টকারদের সম্পর্কে বলা হয়, ‘মধ্য রাতের টকশো ওয়ালারা বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে। কিছু লোক আছে, যারা ফকিরকে এক টাকাও দেন না। রাত ১২ টার পর মাথা গরম করে কথা বলেন। টকশোতে অংশগ্রহণকারীরা ভুলধরা পার্টি, টকশোজীবী, মধ্য রাতের সিঁধেল চোর, টকশো’গুলো বেশি টক, টকশো’র বুদ্ধিজীবীরা দেশের ক্যান্সার, সব জান্তা, বিষফোঁড়া, টক ম্যান, নিজেদের কোন কাজ না থাকায় ক্যামেরার সামনে যেয়ে তারা বিড়বিড় করে। এমন কথার শেষ নেই। মূলত দুর্নীতি পরায়ন ব্যক্তিদের কাছে টক শো টকই মনে হয়। বাস্তবতা বা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে না পারার কারণে তারা টকশো কে ভিন্ন চোখে দেখছে। এতে করে সমালোকদের নিজের জ্ঞান-দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আসে। তাই সবারই উচিত সংযত হয়ে কথা বলা। কেউ যদি টকশোতে উস্কানিমূলক কথা বলেন তাদের মনিটর করা হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে মনিটরিং এর নামে যাতে কারো প্রতি যুলুম করা না হয় সেটি ন্যায়বিচারের দাবি। তবে যারা ক্ষমতায় যায় তাদের কাছে অন্যের ভালো কথাগুলোও ভালো লাগবেনা, এমনটি কাম্য নয়।

mabdulkahhar@gmail.com
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও বা¯তব চিত্র ভিন্ন। ঠুনকো অযুহাতে টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ, পত্রিকা বন্ধ করা, সম্পাদককে জেলে পাঠানো, জনপ্রিয় টকশো ফ্রন্ট লাইন বন্ধ করানো ভাল লক্ষণ নয়। শৃংঙ্খলা জনিত অযুহাত দেখিয়ে বিরোধীদল ও মতের সব ধরণের সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন, তাফসির মাহফিল-এর উপর নিষেধাজ্ঞা শিষ্টাচার বর্হিভূত। অপরদিকে অশ্লীল গান ও নৃত্যের অনুমোদন দেয়া অসুস্থ বিবেকের পরিচয়। সর্বত্রই লিখিত আইনের চেয়ে মৌখিক আইনই প্রয়োগ করায় দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতির নাামে যারা এ কাজগুলো যারা করছে ভবিষ্যতে তাদেরকে এর চেয়েও ভয়াভহ পরিস্থিতি মেনে নিতে হতে পারে। এক সময়ে যাদেরকে লাঠি চার্জ করে রাস্তায় রক্তাক্ত করা হতো তারাই আবার গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছে। সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল সবার জন্যই স্বেচ্ছাচারীতা, দলীয় বিবেচনায় আইন প্রণয়ন, অপরকে নির্মূল করার মানসিকতাকে অবশ্যই বর্জন করা উচিত।

বাংলাদেশ আজ অজানা গন্তব্যে চলছে। নাগরিকরা বাসা থেকে বেড়িয়ে অফিসে যেতে পারছেনা। সাধারণ নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। দলীয় অসাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার অভাব নেই। কেউ গ্রেপ্তার হলে ক্ষমতাসীন বড় নেতার সুপারিশ হলেই কেবল ছাড়া পায়। এছাড়া তাকে জেল ও কোর্ট-কাচারি ঘুরে আসতে হয়। অথবা মোটা অঙ্কের টাকার ব্যবস্থা করা গেলে হয়তো মুক্তি মিলতে পারে। কোথাও কোথাও গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে চলছে টাকার লেনদেন। এটা যে কি ধরণের মানবতার দৃষ্টান্ত তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য এ ধরণের কার্যকলাপ কখনোই কল্যাণকর নয়। এটা বলা যাবেনা, ওটা লেখা যাবেনা, ওইটা করা যাবেনা। এরকম বিধি নিষেধ মেনেই সব কিছু করতে হয়। তবুও ঝুকি নিয়ে দেশবাসির মুক্তির জন্য সোচ্চার দেশবাসি। এই যদি হয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য তাহলে কণ্ঠ রোধের আর বাকি কী ? সর্বোপরি জনগণের স্বার্থে টক শো টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন। টকশোগুলোতে যারা কথা বলেন তাদের সত্য তথ্য দিয়ে, যৌক্তিকভাবে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে কথা বললে আলোচনা অর্থবহ হতে পারে। শ্রোতা-দর্শকরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। টকশোর বক্তারা যদি কতিপয় রাজনীতিবিদদের মতো অসত্য দেন বা কোন দলের অন্ধ অনুসারী হয়ে থাকেন, তাহলে তাদেরকে টকশোতে না যাওয়া উচিত। কেননা, এতে করে সমাধান না হয়ে নতুন করে সমস্যার তৈরী হয়। এক কথায় ক্রিয়ার চেয়ে প্রতিক্রিয়াই বেশি লক্ষ্যণীয়।

লেখক :
শিক্ষক ও কলামিস্ট



মন্তব্য চালু নেই