ঝিনাইদহে মাদকের নীল ছোবল ইয়াবায় ভাসছে যুব সমাজ

আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঝিনাইদহ : মাদক উপত্যাকায় পরিণত হয়েছে ঝিনাইদহ। জেলার ৬ উপজেলায় এখন মাদক বিক্রি হচ্ছে অবাধে। মাদকের অন্যতম গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ঝিনাইদহ। এর অন্যতম কারণ উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নির্বিঘেœ পাচারের নিরাপদ রুট। সীমান্তে বিজিবি আর থানায় থানায় পুলিশ ও র‌্যাব মাদকের এই ভয়াবহতা থামাতে পারছে না। বিশেষ করে সীমান্ত রুটে ব্যাপক ভাবে মাদক প্রবেশ করায় র‌্যাব পুলিশের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। নিয়মিত সন্ত্রাস ও জঙ্গী বিরোধী অভিযান চালানোর পাশাপাশি মাদকের ¯্রােত ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃংখলা বাহিনী। অন্যদিকে ঠুটো জগন্নাথে পরিণত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর। লোকবলের দোয়ায় দিয়ে তারা হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। ব্যাবসায়ীদের লেজ না পেলেও তারা মাছে মধ্যে সেবনকারীদের আটকিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে সক্ষক হচ্ছে। বিজিবির ৬ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের দেওয়া তথ্যমতে গত দেড় বছরে ৫ কোটিরও বেশি টাকার মদক উদ্ধার করেছে তারা। গত ২১ জানুয়ারী এ সব মাদক চুয়াডাঙ্গায় ধ্বংস করা হয়। ঝিনাইদহের খালিশপুর ৫৮ বিজিবি গঠনের পর থেকে সীমান্ত থেকে অর্ধ কোটি টাকার মাদক উদ্ধারের তথ্য রয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিনাইদহ র‌্যাব ও পুলিশ আমদানীর তুলনায় খুব কম পরিমান মাদক উদ্ধার করতে পারছে। অভিযোগ আছে, সখ্যতা থাকায় মাদক স¤্রাটরা থেকে যাচ্ছে অধরা। চুনোপুটি মার্কা ব্যবসায়ীরা পুলিশের জালে বন্দি হলেও এ ব্যবসার আড়ালে থাকা গডফাদাররা গ্রেফতার হয় না। সরকারের বিশেষ একটি সংস্থার রিপোর্ট মোতাবেক ঝিনাইদহ জেলায় কোন না কোন ভাবে জড়িত ৭০০ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীরা প্রায়ই পুলিশ, বিজিবি বা র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হলেও বেশিদিন জেলে আটকে থাকে না। দুর্বল ধারা ও সাক্ষি প্রমানের অভাবে তারা বের হয়ে আসে এবং পুরোদমে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। ঝিনাইদহের রবি নামে এক মাকদ ব্যবসায়ী গ্রেফতারের পর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, এই নিয়ে সে ৪ বার গ্রেফতার হলো। কিন্তু প্রতিবারই জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবারো জড়িয়ে পড়ে মাদক ব্যবসার সাথে। বৈডাঙ্গার গাজা স¤্রাট শহিদুল প্রায় গ্রেফতার হয়। কিন্তু জেলের ভাত তার বেশি দিন খেতে হয় না। সর্বশেষ তিনি র‌্যাবের হাতে বিপুল পরিমান হাঁজাসহ আটক হন। এদিকে সহজলভ্য হওয়ায় এখন ফেনসিডিল ছেড়ে ইয়াবায় ঝুকছে ব্যবসায়ীরা। ফলে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের নীল ছোবল। পানের দোকানেও এখন ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে উঠতি বয়সের যুবকরা আক্রান্ত হচ্ছে মাদক জ্বরে। সরকারের একটি গোয়েন্দ সংস্থার তথ্যমতে ঝিনাইদহ অঞ্চলে এখন প্রভাবশালীরা মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এই তালিকায় অবাক করার মতো তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি। তাদের কাছে তথ্য আছে নামধারী জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মাদকের বড় বড় চালান পাচার হচ্ছে। কতিপয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর ও চেয়ারম্যানরাও জড়িয়ে পড়েছে এই ব্যবসায়। অন্যদিকে পুলিশের কতিপয় সদস্যও মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। গত ২৮ জুলাই চাকলাপাড়ার লুৎফর রহমানের ছেলে মাদক স¤্রাট রবি গ্রেফতার হওয়ার পর কয়েকজন গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যের নাম ফাঁস করে মিডিয়ার কাছে। তাদেরকে তড়িঘড়ি করে অন্য জেলায় বদলী করা হয়েছে। গত ১০ আগষ্ট আরাপপুরে মাদক নিয়ে গোলাগুলি হয়ে একজন গুরুতর আহত হন। এ নিয়ে প্রশাসনের কোন উচ্চবাচ্য নেই, নেই অগ্রগতি। গত ২৭ জুলাই রাতে সাদা পুলিশ পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোক ঝিনাইদহ সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের ছমির উদ্দীনের ছেলে মাদক ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম ও কোলা গ্রামের মৃত সৈয়দ মালিথার ছেলে রেজাউলকে ইয়াবাসহ আটক করে। কিন্তু তাদের থানায় সোপর্দ করা হয়নি। পুলিশ তাদের আটকের কথাও স্বীকার করেনি। এলাকায় ফিরে শহিদুল ও রেজা তাদের আটকের কথা জানিয়ে বলেছে টাকা দিয়ে তারা ছাড়া পেয়েছে। ১৬ আগষ্ট ঝিনাইদহ শহরের পার্কপাড়া থেকে এক প্রকৌশলীর ছেলে ফেনসিডিলসহ ধরা পরে। মোটা অংকের টাকা লেনদেনে মুক্তি পান তিনি। এ ভাবে সাদা পোশাকে মাদক ও মাদকদ্রব্য আটক হলেও থানা পর্যন্ত পৌচাচ্ছে না। রাস্তার মধ্যে দরদাম হাঁকিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অনেক নজীর রয়েছে। ঝিনাইদহের পশ্চিমের এক পুলিশ ফাড়ির এএসআই মাদক ব্যবসা করে অল্প দিনে গ্রামে আলিশান বাড়ি ও মাঠে জমি কিনে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তিনি বদলী হয়েছেন সাতক্ষিরা জেলায়। রাতে একটি সাদা প্রাইভেট কার নিয়ে তিনি মাদক ব্যবসা করতেন বলে এলাকায় কথিত আছে। হরিণাকুন্ডুর রিশখালী এলাকার এক গাজা ব্যবসায়ী ৩ কেজি গাজাসহ গ্রেফতার করে। কিন্তু টাকা নিয়ে ওই এএসআই তাকে ছেড়ে দেয়। কোটচাঁদপুরের মাদক ও চোরাচালান সিন্ডিকেটের গডফাদার রেজাউল পাঠান র‌্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর কতিপয় নামধারী সাংবাদিকের নাম প্রকাশ করেছে। এরা মাদক সেবন ও ব্যবসার সাথে জড়িত। সাংবাদিক সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অনেকেই এখন ঝুকছে মাদক ব্যবসার সাথে। ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর, কালীগঞ্জের বারোবাজার, কোটচাঁদপুর, শৈলকুপার শেখপাড়া, ভাটই, গাড়াগঞ্জ ও মহেশপুরের সীমান্ত এলাকা মাদকের রমরমা হাটে পরিণত হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, খাড়াগোদা ও শরৎগঞ্জ হয়ে প্রতি রাতেই মাদকের বড় বড় চালান ঝিনাইদহে ঢুকছে। এই এলাকার গডফাদাররা এ সব ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করছে। এ বিষয়ে খালিশপুর ৫৮ বিজিবির পরিচালক লেঃ কর্ণেল তাজুল ইসলাম তাজ জানান, সীমান্ত থেকে পাঁচ মাইলের মধ্যে আমাদের এরিয়া। এর বাইরে কোন কিছু হলে আমাদের আইনগত কিছু করার নেই। তিনি বলেন প্রতিনিয়িত আমরা সীমান্তে মাদক বিরোধী অভিযান চালাচ্ছি। শুক্রবারও আমরা মদ ও ৭২ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছি। তিনি বলেন, মাদকের শ্রোত ঠেকাতে আমরা সীমান্তে অভিযানের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। ইমামদের মাধ্যমে মসজিদে মসজিদে মাদক নিয়ে ইসলামের দৃষ্টি ভঙ্গি তুলে ধরছি। সীমান্তে মেম্বর ও চেয়ারম্যানদের নিয়ে কাজ করছি। তারপরও মাদকের ভয়াবহতা ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের আটক করে মামলা দিই। এরপর আমাদের আর কোন কাজ নেই। বিজিবির আরেকটি সুত্র জানায়, মাদক ব্যবসায়ীরা সব সময় সরকারী দলের ছত্রছায়ায় ব্যবসা করে। এ জন্য তাদের গ্রেফতার করলেও বেশিদিন আটকানো যায় না। এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, মাদকের সাথে সমাজের অনেকই জড়িত। তারপরও পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। অভিভাবকরা সচেতন না হলে পুলিশের একার পক্ষে মাদক নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব নয়। তিনি জানান, আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের ধরছি, কিন্তু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে আবার পুরানো পেশায় ফিরে আসছে।



মন্তব্য চালু নেই