দু’দশক ধরে মেয়র পদ নিয়ে দ্বন্দ-সংঘাত-আইনী জটিলতার অভিশাপ
ঝালকাঠি পৌরসভার প্রথম ক্ষমতা দখলকারী প্যানেল চেয়ারম্যান বর্তমান মেয়র আফজালেরও একই পরিনতি ?
বিগত কয়েক মেয়াদ ধরে পৌর চেয়ারম্যান বা মেয়র পদ নিয়ে দ্বন্দ-সংঘাত ও আইনী জটিলতা সৃষ্টির বিষয়টি এখোন ঝালকাঠি পৌরবাসীর জন্য নিয়মে পরিতন হয়েছে। বিগত নব্বইয়ের দশকে প্রথমবারের মতো তৎকালীন নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যানকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল তৎপরতা শুরু পর থেকে প্রায় দু’দশক ধরে এহেন লড়াই, সংঘাত ও আইনী জটিলতা চলে আসছে। নির্বাচিত চেয়রম্যানকে পেশীশক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল ও মনগড়া-বানোয়াট মামলায় দিয়ে হয়রানির ঘটনা ঘটানো তৎকালীন ১নং প্যানেল চেয়ারম্যান আফজাল হোসেনেরও এখোন একই পরিনতির বরন করতে হয়েছে।
ধারাবাহিক ভাবে প্রতি মেয়াদেই স্থানীয় সরকারের পৌর বিধি লংঘন সহ ক্ষমতা ও পেশীশক্তির ব্যবহার করে চেয়ারম্যান বা মেয়রের পদ দখলের ঘটনা অভিশাপের ন্যায় পৌরবাসীর ললাটে কালিমা লেপন করেছে। আর এসবের নেপথ্যে কখোন প্রভাবশালী রাজৗনতিক নেতা মন্ত্রী-এমপিদের মনোভাব, কখোন আইনের ফাঁকফোঁকর বা মারপ্যাচ অথবা মন্ত্রনালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের তৎপরতা নেয়ামক ভূমিকা রেখেছে বলে স্থানীয় কয়েকজন প্রবীন নাগরিক ও সাবেক কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এ তথ্য জানিয়েছে।
সম্প্রতি ঝালকাঠি পৌরসভার বর্তমানে মেয়র আফজাল হোসেন রানা চাঁদাবাজী মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর আবারো নুতন করে সেই ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়েছে। যে কারনে দেশের প্রচীনতম পৌরসভা ও বানিজ্যিক বন্দর হয়েও প্রায় দু’দশক ধরে ঝালকাঠি পৌরসভা সার্বিক উন্নয়নে পিছিয়ে ও নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। মেয়র আফজাল জেলহাজতে যাওয়ায় দুই প্যানেল মেয়রের মধ্যে কে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পাবে তাই নিয়ে সর্বস্তরের পৌরবাসীর মধ্যে আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা চলছে। এঅবস্থায় ঝালকাঠি পৌরসভাটি স্থানীয় পৌরবাসীরা কাছে একটি অভিশপ্ত প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে বলে তারা মতব্যক্ত করেছেন।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে প্রবীন-সচেতন কয়েকজন নাগরিক ও সাবেক কয়েক জনপ্রতিনিধি জানায়, ঝালকাঠি পৌরসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে হটিয়ে চেয়ারম্যান পদ দখলে তৎপরতা প্রথম শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। ১৯৯৬-৯৭ সালে ঝালকাঠি পৌরসভার চেয়ারম্যান আঃ হালিম গাজীকে রাজনৈতিক প্রভাবে মন্ত্রনালয় থেকে অপসারন, মনগড়া মামলা ও পেশীশক্তির বলে তৎকালিন পৌরকমিশনার ১নং প্যানেল চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন রানার চেয়ারম্যান পদ দখল করেন।
পরে আদালত থেকে জামিন ও উচ্চ আদালত থেকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ফিরে পেলেও দীর্গ ৯মাস পেশীশক্তির বলে আফজাল ও তার দলবল ক্ষমতা দখল করে থাকার পর আদালত ও প্রশাসনের উদ্দোগে চেয়ারম্যানের পদ ফিরে পায় আঃ হালিম গাজী। সে সময় গুঞ্জন ছিল ‘আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য আলহাজ্ব আমির হোসেন আমু সমর্থনেই’ পৌরকমিশনার ১নং প্যানেল চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা আফজাল এ পদ দখল করে ছিলো।
১৯৯৮ সালে পৌরসভার নির্বাচনে আ’লীগের ‘দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামীলীগ নেতা খান সাইফুল্লাহ পনির, আফজাল হোসেন, মরহুম চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেনের মধ্যে বিরোধের জের আফজাল ও তার সমর্থকরা শেখহাসিনার গাড়ীর বহরে ও আমির হোসেন আমুর বাসায় হামলা-ভাংচুর করে। পরে একই দলে ৩ প্রার্থীর মধ্যে আ’লীগের মোঃ বেলায়েত হোসেন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও দীগী কয়েক বছর চেয়ারম্যান-কমিশনারদের ক্ষমতার লড়াইয়ে দূর্ভোগ বয়ে বেরায় পৌরবাসী।
পরবর্তী মেয়াদে ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আ’লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসাবে মোঃ বেলায়েত হোসেন, বিদ্রোহী প্রার্থী আফজাল হোসেন, বিএনপি সহ ৪ দল সমর্থিত প্রার্থী (বর্তমান শহর আ’লীগ সেক্রেটারী) ব্যবসায়ী মাহাবুব হোসেন, বিদ্রোহী প্রার্থী ডেলটা লাইফ ইন্সুরেন্স চেয়ারম্যান সৈয়দ মেয়াজ্জেম হোসেন ও সাবেক চেয়ারম্যান আঃ হালিম গাজী পৌরমেয়র পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। নির্বাচনে আঃ হালিম গাজী পৌরমেয়র নির্বাচিত হলেও বিএনপি সরকারের তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান ওমরের সাথে আতাঁত করে নিকটতম প্রতিদ্বন্দি আ’লীগ নেতা আফজাল হাইকোর্টে মামলা দায়ের করলে ২০০৫ সালে
প্রায় ১৪ মাস আইনী লড়াই শেষে সুপ্রীমকোর্টের রায়ের মধ্যদিয়ে হালিম গাজী মেয়র পদে বসতে সক্ষম হন। মাত্র ৩ বছরের মাথায় সেনা সমর্থিত ১/১১ এর সরকারের আমলে সেনা অভিযানে হালিম গাজী গ্রেপ্তার হলে কাউন্সিলর আইউব আলী তালুকদার প্যানেল মেয়র হিসাবে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হলে ১নং প্যানেল মেয়র মকবুল হোসেন আকনের সাথে শুরু হয় আইনী লড়াই। প্রায় ১১ মাস কাউন্সিলর আইউব আলী তালুকদার প্যানেল মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে উচ্চআদালতের মাধ্যমে হালিম গাজী মেয়র পদ ফিরে পেলেও ২০০৯ সালে নির্বাচনের পূর্বে পৌরসভার সীমানা নিয়ে পুনরায় শুরু হয় আইনী লড়াই।
২০১০ সালের মার্চে পৌরসভার নির্বাচিনে শহর আলীগ সভাপতি লিয়াকত আলী তালুকদার ও আ’লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসাবে আফজাল হোসেন মেয়র পদে নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নেয়। ভোটগননা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই আফজাল হোসেন পদে ক্ষমতা গ্রহন করলেও এক সময়ের রাজনৈতিক গুরু ঝালকাঠি-২ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আমির হোসেন আমুর সাথে নির্বাচনের পূর্বেই চরম বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। এমন কি ঝালকাঠির উন্নয়নের রুপকার হিসাবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এ নেতাকে পৌরএলাকার সকল উন্নয়নের বাইরে রেখে একচ্ছত্র কর্মকান্ড চালাতে থাকলেও সীমাহীন দূর্নীতি-লুটপাট, পরিবারতন্ত্র ও পেশীশক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নিজদল সহ পৌরবাসীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় পৌরপরিষদের ১০ জন কাউন্সিলর ২নং প্যানেল মেয়র রেজাউল করিম জাকিরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হলে মেয়র আফজালের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও সে তার বিশ্বস্ত সহচর ১নং প্যানেল মেয়র প্রনব কুমার নাথ ভানুকে নিয়ে একনায়কতন্ত্র চালাতে থাকে। বর্তমানে নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দি লিয়াকত তালুকদারের ব্রীকফিল্ডের এক শিশু অপহরন ও গুম মামলা, দূদক’র তদন্তাধীন ৩টি দূর্নীতি মামলা, ঘুষ-দূর্নীতি-সত্রাসীর ৩/৪টি মামলাসহ একটি চাঁদাবাজীর মামলায় চার্জশীটভূক্ত আসামী হয়ে বিতর্কিত মেয়র আফজালের জেলহাজতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ভারপ্রাপ্ত মেয়র কে হবেন তাই নিয়ে আফজাল সমর্থিত ১নং প্যানেল মেয়র ভানু ও ১০ কাউন্সিলর সমর্থিত ২নং প্যানেল মেয়র রেজাউল করিম জাকিরের মধ্যে শুরু হয়েছে লড়াই।
সর্বশেষে আর ২মার্চ মেয়র আফজালের জেলে যাওয়ার পর থেকে শুরু হওয়া এ লড়াইয়ের জের ধরে জাকিরের সমর্থক কাউন্সিলর হুমায়ূনের বাসায় বোমা হামলা, ১নং প্যানেল মেয়র ভানু কে কথিত অপহরন চেষ্টার অভিযোগ, দুই পক্ষের সমর্থনে স্থানীয় ছাত্রলীগ-যুবলীগ দুই গ্রুপে মহড়া, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও হামলা পাল্টা হামলার ঘটনায় শংকিত হয়ে পড়েছে ঝালকাঠি পৌরবাসী।
বর্তমানে মেয়র জেলে যাওয়ার পরপরেই পৌরপরিষদের ১০ কাউন্সিলর প্যানেল মেয়র জাকিরের নেতৃত্বে পৌরভবনে শিল্পমন্ত্রী আমুর ছবি উত্তেলন ও বিশেষ সভা করে ৩ মার্চ ঢাকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্র্রনালয়ে অবস্থান নিয়েছে। আর মেয়রের এতোদিনের একান্ত অনুগত ১নং প্যানেল মেয়র ভানুও ঢাকা গিয়ে শিল্পমন্ত্রীর সাথে সাক্ষত করে তার দায়িত্ব পালনের অনুমতি নিয়ে ঝালকাঠি এসেছে বলে প্রচার করা রয়েছে।
আফজাল জেলে যাওয়ার পর প্যানেল মেয়র জাকিরের নেতৃত্বে ১০ কাউন্সিলর, জেলা ছাত্র ও যুবলীগ শহরে আনন্দ মিছিল করলেও ৪মার্চ থেকে শহর যুবলীগ আহবায়ক হাফিজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-যুবলীগের বড় একটি অংশ ১নং প্যানেল মেয়র ভানুর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এ অবস্থায় দুপক্ষই কার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাবে তাই নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতায় ভূগছে। আর কতো দিনে ঝালকাঠি পৌরবাসী এই অভিষাপ থেকে মুক্তিপাবে ও তাদের নাগরিক সুবিধা সহ উন্নয়ন নির্বিগ্নে পরিচালিত হবে সেই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে।
মন্তব্য চালু নেই