ব্রিটিশের নৃশংস হত্যার সাক্ষী

ঝালকাঠির কুলকাঠি ঐতিহাসিক হত্যা যজ্ঞ দিবস পালন উপলক্ষ্যে মাহফিল অনুষ্ঠিত

২ মার্চ উপমহাদেশের হৃদয় বিদারক, লোমহর্ষক, কলঙ্কময় ও ঐতিহাসিক কুলকাঠি হত্যাযজ্ঞ দিবস। ব্রিটিশ শাসনামলের এ ঘটনা ‘দ্বিতীয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড’ নামেও পরিচিত। ৮৪ বছর আগে ১৯২৭ সালে (বাংলা ১৩৩৩ সনের ১৮ ফাল্গুন) এ দিনে মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করতে গিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইএন ব্লান্ডির হুকুমে গুর্খা সৈন্যদের গুলি বর্ষণে শহীদ হন ঝালকাঠির কুলকাঠি এলাকায় ১৯ জন ধর্মপ্রাণ মুসলমান।

এ সময় আহত হন অসংখ্য মুসলিম জনতা। ঐতিহাসিক ও বেদনাময় এ দিনটি পালনের জন্য প্রতিবছরের মত এবারেও কুলকাঠি মসজিদ কমিটির উদ্যোগে স্মরণসভা, ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল এবং বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। সোমবার আসর নামাজের পর কর্মসূচি শুরু হয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত এ কর্মসূচী পরিচালিত হয়। ঝালকাঠির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও মুসলিম ধর্মীয় নেতারা এ কর্মসূচীতে যোগদান করেছেন।

ঝালকাঠি শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত সুগন্ধা নদীর দক্ষিণ তীরে সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ও নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি দুটি ইউনিয়ন ছিল ঘটনাস্থল। সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নে হিন্দু সম্প্রদায়ের আন্তর্জাতিক ৫২টি ধর্মীয় স্থানের মধ্যে ৩য় তীর্থস্থান শিববাড়ির অবস্থান। প্রাচীন কাল থেকে প্রতিবছর শিবচতুর্দশী উপলক্ষে শিববাড়িতে বিরাট মেলা বসে। এখন দুই-তিন দিনে সীমাবদ্ধ হলেও আগে পক্ষকাল থেকে মাসব্যাপী মেলা চলতো। শিববাড়ির কাছেই জেলার নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি গ্রামটি অবস্থিত। ইংরেজ আমলে ১৯২৬ সালে এ গ্রামে একটি জামে মসজিদ নির্মিত হয়। হিন্দুরা ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে মসজিদ সংলগ্ন রাস্তা দিয়েই মেলায় যাতায়াত করায় মুসলমানদের ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটে।

এ নিয়ে মসজিদের ইমাম মৌলভী সৈয়দ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুসুল্লীরা হিন্দু নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করে সুফল লাভে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় মুসলমানগণ মসজিদের পাশে রাস্তা দিয়ে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে যেতে না দেয়া অপরদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরা বাধ্য-বাজনা সহকারেই শিব মন্দিরে যাবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে।

খবর পেয়ে বিখ্যাত হিন্দু নেতা সতীশ সেন একদল ‘ হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক’ নিয়ে শিববাড়ি-কুলকাঠি এলাকায় অবস্থান নেন। শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায় বাকেরগঞ্জের তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইএন ব্লান্ডি, পুলিশ সুপার মি. টেলর এবং সদর এসডিও জিকে বিশ্বাস ২ মার্চ বুধবার, গুর্খা বাহিনী নিয়ে কুলকাঠি আসেন। দু’পক্ষের বিরোধের এক পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট ব্লান্ডি মুসলমানদের ওপর গুলি করার জন্য গুর্খা সৈন্যদের নির্দেশ দিলে ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন ১৯ জন মুসল্লী আর আহত হন অনেকেই। পুরো বাকেরগঞ্জ জেলা সহ দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। বরিশালে ময়না তদন্তের পর হেমায়েত উদ্দিন মাঠে অনুষ্ঠিত নামাজে জানাজায় শোকে মুহ্যমান হাজার হাজার মুসলমান অংশ নেন। পরে শহীদদের স্বজনরা গ্রামে এনে মসজিদের কাছে দাফন করেন।

বীর শহীদরা হন- বাবর উল্লাহ হাওলাদার, আফেল গাজী, নঈম উদ্দিন হাওলাদার, এয়াসিন আকন, আতামুদ্দিন হাওলাদার, হাসান উল¬াহ হাওলাদার, মোসলেম উদ্দিন, মোহন মোল্লা, সেরাজ উদ্দিন, সুন্দর খান, ছবদার খান, মফেজ হাওলাদার, রহমালি হাওলাদার, বলু খান, রিয়াজ উদ্দিন, জাহের তালুকদার, জহির উদ্দিন হাওলাদার, আবুল হোসেন হাওলাদার ও ফরমান উল্লাহ। তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের পত্রপত্রিকায় ফলাও করে এ নৃশংস হত্যকান্ডের খবর প্রকাশ করা হয়। মাসিক সওগাত পত্রিকা ঘটনাটিকে ‘দ্বিতীয় জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।

খবর পেয়ে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক কুলকাঠিতে ছুটে এসে এক জনসভা করেন। হত্যাকান্ডের নায়ক ব্লান্ডিকে ‘ব্লাডি’ বলে আখ্যায়িত করেন। নরহত্যার অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়। সরকার পক্ষ মামলায় হেরে গিয়ে প্রত্যেক শহীদ পরিবারের জন্য চরমোয়াজানে দশ কানি জমির বরাদ্দ দেয়। কবরস্থানের চারদিকে দেয়াল এবং মসজিদটি ভালভাবে নির্মাণ করে দেয়া হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ব¬ান্ডি ক্ষমা প্রার্থনাও করে। ১৯ শহীদের স্মৃতি রক্ষা কুলকাঠির চন্ডিপ্রসাদ হাইস্কুলটির নামকরণ করা হয় ‘কুলকাঠি শহীদিয়া ইউনিয়ন একাডেমী’ যা বর্তমানে কুলকাঠি শহিদীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিত।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে কুলকাঠির শহীদদের স্মৃতি আজ বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অযতœ-অবহেলায় পড়ে আছে ১৯ শহীদের কবর।

স্থানীয়ভাবে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। বিদেশি অর্থে মসজিদেরও কিছু উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তবে ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিময় স্থাপনাগুলো যথাযথ সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য সরকারীভাবে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এত বড় ঘটনা কালের সাক্ষী হিসেবে থাকলেও বর্তমান প্রজন্মের কাছে সে ইতিহাস অজানাই থেকে যাচ্ছে।



মন্তব্য চালু নেই