মুক্তিযোদ্ধা পিপি এড. হায়দার হত্যার মামলার রায়

ঝালকাঠিতে ৫ জেএমবি কিলারের মৃত্যুদন্ড

দেশের ইতিহাসে প্রথম চাঞ্চল্যকর জেএমবির জঙ্গী হামলায় দুই বিচারক হত্যা মামলা পরিচালনাকারী ঝালকাঠির সরকারী কৌসুলী ও মুক্তিযোদ্ধা পিপি এড. হায়দার হোসাইন হত্যার চাঞ্চল্যকর মামলার ৫ জনকে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে। ১১ ফেব্রুয়ারী বুধবারে এ রায় প্রদাণ করা হয়। নির্ভিক সাহসিকতার সাথে মামলা পরিচালনার করায় বিচারক সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাড়ে হত্যা মামলা শীর্ষ ৭ জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় জেএমবির জঙ্গীরা ১মাসের আল্ট্রিমেটাম দিয়ে তাকে হত্যা করে।
দীর্ঘ ৮ বছর পর ঝালকাঠি সহকারী জেলা জজ আদালতের বিচারক মোঃ আঃ হালিম এ রায় প্রদান করেন। রায় প্রদানের সময় শাহাদাৎ মো: তানভীর, খুলনার মুরাদ হোসেন ও আমীর হোসেন আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত থাকলেও বরগুনার বেলাল ও ছগির পলাতক রয়েছে। অন্যদিকে এঘটনায় দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর নানা চরাই উৎরাইয়ের পর রায় প্রদান করা হয়। দেরীতে হলেও মামলার রায়ে নিহতের স্ত্রী মিসেস কহিনুর বেগম সন্তোষ প্রকাশ করে নিজের ও তার ছেলে-মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তুলে ধরেন। এবিষয়ে তিনি সরকার ও প্রশাসনের কাছে জীবনের নিরাপত্তার দাবী জানিয়েছেন।
মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর জেএমবি আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে ঝালকাঠির দুই বিচারক জগন্নাথ পাড়ে ও সোহেল আহম্মেদকে হত্যা করে। ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০০৬ সালের ২৯ মে দুই বিচারককে হত্যার দায়ে জেএমবি প্রধান শায়খ আঃ রহমান এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইসহ শীর্ষ ৭ জঙ্গির ফাঁসির আদেশ দেন।
২০০৭ সালের ২১ মার্চ দেশের বিভিন্ন কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জেএমবির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে এই মামলা পরিচালনার জন্য তার উপর প্রতিশোধ নিতেই পিপি হায়দারকে জেএমবি হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ৭ শীর্ষ জঙ্গীর ফাঁসির এ আদেশ কার্যকর হওয়ার ২০ দিন পর তাকে ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল শহরের মধ্যে গোরস্তান মসজিদ থেকে এশার নামাজ পড়ে বের হলে মসজিদ চত্বরেই তাকে গুলি করে হত্যা করে।
ঘটনার পর পর পিপির পরিবার সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, নিহত পিপি হায়দার জেলা প্রশাসকের কাছে তার জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করলেও উক্ত আবেদনের প্রতি প্রসাশন গুরুত্ব দেয়নি। এ অবস্থায় তৎকালীন ওয়ান ইলেভন সরকারের সময়ে সেনাবাহিনীর উপস্থিতে জেলা শহরের মধ্যে রাত ৮টায় এশার নামাজ শেষে বের হলে জঙ্গীরা গুলি করে পিপি হায়দার হোসাইন কে হত্যা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায়।
এ ঘটনার পরের দিন নিহত’র এক মাত্র ছেলে তারিক বিন হায়দার বাদী হয়ে ঝালকাঠি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপ-পরিদর্শক মোশারেফ হোসেন হত্যা ঘটনার প্রায় তিন বছর পর ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি জেএমবির পাঁচ ক্যাডার আবু শাহাদাৎ মো: তানভীর, আমীর হোসেন, খুলনার মুরাদ হোসেন, ঢাকার ছগির হোসেন ও বরগুনার বেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
নিহত’র ছেলে মামলার বাদী তারিক বিন হায়দার তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমার বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে বর্তমান সময়ে সরকার পক্ষ মামলাটির বিচারে অনেক বিলম্ব করলেও শেষ পর্যন্ত এ রায়ে আমরা শুকরিয়া প্রকাশ করছি। একই সাথে সরকার ও মামলা পরিচালনায় সম্পৃক্ত আইনজীবীদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমার শুধু একটা দাবী, তাঁর অবদান রক্ষার্থে শহরের নতুন কলেজ রোডটি নিহত তার নামে নামকরণ অথবা তার নামে শাহাদাৎ বরনের স্থলে কোন নামফলক করা হলে আমরা বাবার আত্মা শান্তি পাবে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি জেএমবির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনার জন্য প্রতিশোধ নিতে জেএমবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হায়দার হোসাইনকে উক্ত আসামীরা দলীয় সিদ্ধান্তে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পত্রেও উল্লেখ করেন । অভিযোগপত্র দাখিলের পর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত গত ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর মামলাটি বিচারের জন্য বরিশাল দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করেন। ট্রাইব্যুনাল ১৩৫ কার্য দিবসে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার পরই ট্রাইব্যুনালের বিচার সম্পন্ন করার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এ কারণে গত ২০১১সালের ২৬ জুন ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পুনরায় ঝালকাঠির আদালতে ফেরত পাঠান। গত ২০১১ সালের ১২ জুলাই ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির পুনর্বিচার শুরু হয়। এ দিন আসামি মুরাদের স্বীকাােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধকারী ম্যাজিস্ট্রেট (৫৬ নং সাক্ষী) মেহেদী মাসুদুজ্জামান কে তলব করে মামলাটি বিচারের জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বদলি করে। ২০১১সালের ২১ নভেম্বর ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদুজ্জামান আদালতে সাক্ষী প্রদান করলেও শুধুমাত্র তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ বাকী থাকে। ইতিমধ্যে ২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পলাতক আসামি বেল¬াল ও ছগির হোসেনের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মনজুর হোসেন জেরার জন্য পাঁচ জন সাক্ষীকে রি-কল করার আবেদন করেন। আদালত নিহত হায়দার হোসাইনের ছেলে মামলার বাদী তারিক বিন হায়দার, নিহতের সহকারী আ: মান্নানসহ পাঁচ জনকে রি-কল আদেশ গ্রহন করলে তাদেও পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহন ও তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহন শেষে ১১ ফব্রুয়ারী এ রায় প্রদান করা হয়।



মন্তব্য চালু নেই