জয় হোক মাহিনুরদের স্বপ্নের

দিনের আলো শেষ হতেই রাজপথের ঝুপরি থেকে দল বেধে পথে নামে পথশিশু। হাতে মোলায়েম সৌরভ ছড়ানো একগুচ্ছ বেলি ফুলের মালা, গায়ে ছেড়া ময়লা মাখা জামা। তবু এদের কাছ থেকে সামর্থবানরা মালা কিনে আরেক দফা নিজেদের সৌখিনতাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালায়। অপরদিকে দলবেধে রাস্তায় ছোটাছুটি একটা ফুলের মালা অথবা রঙিন বেলুন বিক্রির আশা। কিংবা কাঁধেচাপা বস্তা ভর্তি কাগজ-প্লাস্টিক..

এমন একজন পথশিশু মাহিনুর। ধানমন্ডি ১৫নং ইউআইইউ (UIU) ক্যাম্পাস এর সামনে ব্যস্ততম সড়কে দাঁড়িয়ে যখন কথা হল, ঘড়ি বলছে রাত ৮টা। হাতে একটা লাঠিতে ঝুলানো কিছু বেলি ফুলের মালা। লিকলিকে গড়নে ছেড়া ফাটা ময়লা জামা, চুলে ধুলা বালির আস্তরণ।

মাহিনুরের বয়স ৫ কিংবা ৬। প্রথম শ্রেণিতে পড়াশুনা করছে “আপন” নামে পথশিশুদের জন্য গড়া বিদ্যালয়ে। পরিবারের সঙ্গে থাকে রাজধানীর রায়ের বাজার ফুটপথ। পাঁচ ভাইবোনের মাঝে মাহিনুর ২য়, বড়ভাই একটা খাবারের দোকানে কাজ করে। মা ফুলের মালা বানায়। বাবার কথা জানতে চাইলে বলে “হেরে তো মুই দেহি নাই, কবে গেছে গা”। রাতের রাস্তায় ভয় লাগে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহিনুর জানায়, “আগে ভয় ভয় লাগলেও এখন আর ভয় লাগে না।

রাজধানী ঢাকার নিত্যকার চিত্রে এমন হাজার গল্প লেপটে আছে। শাহবাগ, কমলাপুর, গুলিস্তান, মগবাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, মিরপুর, সাভার থেকে আব্দুল্লাহপুর এবং উত্তরা। সন্ধ্যা কিংবা সকাল রাস্তায় দু-পা বাড়ালেই চোখে পড়বে এমন ছিন্নমূল শিশুদের। এদেরকে টোকাই নামেই ডাকে সবাই, পথেই এদের বাস।

মাহিনুরের এভাবে কাজ করতে ভালো লাগে না। কারণ হিসেবে জানালো, খেলা করতে পারি না। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ক্লাস করে মাহিনুর বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। প্রতিদিন গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় করে ফুলের মালা বিক্রি করে।

মাহিনুর স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। ডাক্তাররা নতুন নতুন গাড়িতে চড়ে আর রুগী দেখে, তাই আমিও বড় হয়ে ডাক্তার হবো। শুধু মাহিনুর নয় এমন হাজার মাহিনুর স্বপ্নে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি, র‍্যাব, পুলিশ হতে চাই।

জাতিসংঘের শিশু সনদ ও বাংলাদেশ শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সীদেরকে শিশু ধরা হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু। যাদের ৪০ ভাগ বাস করে দারিদ্রসীমার নিচে। এক হিসাবে দেখা যায় বাংলাদেশে শিশু শ্রমিক এর সংখ্যা প্রায়৭৯ লাখ।

ICFDRB ও MARA এর প্রকাশিত ২০১২ সালের তথ্য মতে, বাংলাদেশে পথ শিশুদের সংখ্যা ৪ লাখ ৪৫ হাজার। যাদের বসবাস ঢাকাসহ দেশের ছোট-বড় শহর, বন্দর, রেলওয়ে স্টেশন, ফুটপাথ, বাস স্ট্যান্ড কিংবা বস্তির ঝুপরিতে।

শহুরে সোডিয়াম লাইটের সেই আলো ক্রমশ যখন গাঢ় হচ্ছে, তখন মাহিনুরদের স্বপ্নের বিজ বপন করতে শুরু করেছে হৃদয়ে। জয় হোক মাহিনুরদের স্বপ্নের। এমন হাজার মাহিনুরের স্বপ্নই হয়তো যোগ হয়ে বাংলাদেশকে পৌঁছে দেবে চুড়ান্ত লক্ষ্যে।



মন্তব্য চালু নেই