জ্ঞানবিতর্কে কে এগিয়ে অর্থমন্ত্রী, না শিক্ষকরা?

গেল সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে গ্রেড ভেদে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের মূল বেতন ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু বেতনভাতা দ্বিগুণ বাড়িয়েও কোনো পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি এই স্কেল। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় ক্যাডার থেকে নন-ক্যাডার, মধ্যম সারি থেকে নিম্ন সারির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম অসন্তুষ্ট। সরকার সমর্থক কর্মচারী সংগঠন থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীরাও টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে।

বুধবার ২৬টি ক্যাডার ও বিভিন্ন ফাংশনাল সার্ভিসের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) সমন্বয় কমিটি বৈঠক করে আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একই দিনে আন্দোলনের কর্মসূচী ঠিক করতে কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন জরুরি বৈঠক করেছে। এদিকে অষ্টম পে-স্কেলে বৈষম্য দূরীকরণ ও পুন:নির্ধারণ, শিক্ষকদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠাসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলনরত ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লাগাতর অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছেন। গেল তিনদিন থেকে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ-সমাবেশ করার পর আজ তারা নতুন করে আগামী রোববার ও বৃহস্পতিবার কর্মবিরতির কর্মসূচী ঘোষণা করেছে।

অন্যদিকে আজ বৃহস্পতিবার থেকে সব সরকারি কলেজেও কর্মবিরতি পালন করছে শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও বিসিএস শিক্ষা সমিতি পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণে আলাদা জরুরি সভা করার কথা রয়েছে। শিক্ষকদের দাবির প্রতি বিএনপি, এমন কি ১৪দলের বেশ কয়েকজন নেতারাও সমর্থন জানিয়ে শিক্ষকদের সাথে আলোচনায় বসার আহবান জানিয়েছেন।

এদিকে শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর ক্লাস এবং পরীক্ষা হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসন্ন ভর্তি পরীক্ষাও এর কবলে পড়তে পারে। অন্যদিকে শিক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে গেল দুই দিন থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। ফলে সার্বিকভাবে শিক্ষাখাত তথা শিক্ষার্থীরা বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা। সবমিলেই পে-স্কেল নিয়ে শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত ও অচল।

রাজনৈতিক আদর্শ আর স্বার্থের বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা নানা দলে বিভক্ত থাকলেও পে-স্কেল ইস্যুতে অন্তত তারা একজোট হয়েছে। ফলে বলা এই আন্দোলনের ভিত বেশ শক্ত। এরই মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের চার দফা দাবির প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘এটা করাপ্ট প্র্যাকটিস। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মসূচির কোন যথার্থতা নেই। সমাজের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছে। তারা জানেই না যে, পে-স্কেলে তাদের জন্য কী রাখা হয়েছে, আর তারা কী পায়নি। তাদের মান-মর্যাদা কোথায় ক্ষুন্ন হয়েছে, আমি তো কোথাও কিছু দেখি না। শিক্ষকদের ব্যবহারে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। তাদের যে করাপ্ট প্র্যাকটিস এটা বন্ধ করা দরকার। ব্যুরোক্রেসিকে যেভাবে ম্যানেজ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় স্টাফদেরও একইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিক্ষকদের পদোন্নতির নিয়মটি তারা নিজেরাই তৈরি করেছেন। তারা ইচ্ছেমতো প্রমোশন দেন। সবাই অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক হতে চায়। এ সময় শিক্ষকদের পদোন্নতিতে সংস্কার দরকার, আমি মন্ত্রিসভা কমিটিকে এ বিষয়টি অবহিত করবো।’

অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য যেন শিক্ষকদের আন্দোলনে ঘি ঢেলেছে। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে শুধু অনভিপ্রেত নয়, অসংলগ্ন বলে মন্তব্য করে মঙ্গলবার বিকেলেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন বিবৃতিতে বলেছে, ‘বস্তুতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক ও শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের কারণেই তিনি (অর্থমন্ত্রী) এরূপ দায়িত্বহীন মন্তব্য করেছেন।’ এদিকে বক্তব্য প্রত্যাহার ও নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে অর্থমন্ত্রীকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন শিক্ষকরা। এই সময়ের মধ্যে বক্তব্য প্রত্যাহার না করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উদ্ভূত যে কোন পরিস্থিতির দায়ভার অর্থমন্ত্রীকে নিতে হবে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।

বিবৃতিতে ফেডারেশন শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বলেন, ঘোষিত বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চার দফা দাবির কোনটিই গ্রহণ না করে এবং সুনির্দিষ্ট কোন দিকনির্দেশনাও না দিয়ে উপরন্তু অর্থমন্ত্রী মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমে শিক্ষকদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, যা শুধু অনভিপ্রেতই নয় অসংলগ্নও বটে। এছাড়া বুধবার অর্থমন্ত্রী মুহিতকে ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ও অযোগ্য’ উল্লেখ করে তার অপসারণ দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

সাধারণভাবে আমরা জানি দু’পক্ষই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রাজ্ঞ। কিন্তু উভয়পক্ষই যেভাবে নিজেদেরকে জ্ঞানের অভাবের কথা বলেছেন, তাতে বিষয়টি কিছুটা পর্যালোচনার দাবি রাখে। প্রথমেই আসি অর্থমন্ত্রীর বিষয়ে। আমরা সবাই জানি মি. মুহিত একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদ, তিনি সংসদে নয়বার বাজেট উত্থাপন করেছেন। লেখক হিসেবেও সমান পারদর্শী- মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ইতিহাস, জনপ্রশাসন এবং রাজনৈতিক সমস্যা বিষয়ক গ্রন্থসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ২৩টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত একজন দক্ষ আমলা হিসেবেও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। শিক্ষাজীবনে মেধাবী ছাত্র হিসেবে লেখাপড়া করেছেন ঢাকা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।

এতো কিছুর পরও সাম্প্রতিককালে তার বেশ কিছু বক্তব্য নানা বিতর্কের সৃষ্টি করে। নিজ দলেই তিনি মহা বিড়ম্বনার কারণ। তার ফটকাবাজ, রাবিশ, বোগাস ও ননসেন্স, ‘হলমার্ক কিংবা বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি কোনো ঘটনাই না প্রভৃতি মন্তব্য সারা দেশেই তুলেছিল আলোচনা ও কৌতুকের ঝড়। শেয়ারবাজার থেকে যখন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব, অনেকেই আত্মহত্যা করছেন, তখন অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য—‘শেয়ার মার্কেটে কোনো ইনভেস্টর নেই, সব জুয়াড়ি, ফটকাবাজ,’ ‘অ্যাই অ্যাম একদম ফেডাপ…।’ এজন্য অনেক সময় প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিব্রতবোধ করেছেন। এরপরও অর্থমন্ত্রীর এমন চমকপদ বক্তব্য থামেনি। সর্বশষে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের বিষয়ে মন্তব্য করলেন। এ নিয়ে গেল দুই দিন ধরে বিভিন্ন মহলে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। এই সমালোচনা সংসদেও গড়িয়েছে। গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে শিক্ষকদের নিয়ে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেন স্বতন্ত্র এমপি তাহজিব আলম সিদ্দিকী।

অনেকেই মনে করেন, অর্থমন্ত্রী সরাসরি এভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে বরং আন্দোলনরত শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনায় বসতে কিংবা পে-স্কেল অনুমোদনের আগেই শিক্ষকদের সাথে একটা সমঝোতায় যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে শিক্ষকদের বিষয়ে আপত্তিকর বক্তব্য করেন। যা শিক্ষকদের জন্য মর্যাদাহানিকর তথা জাতির জন্য লজ্জাস্করও বটে। জানি না, অর্থমন্ত্রী ও সরকার এ বিষয়ে ভাবছেন। তবে বিষয়টি যে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেসব দাবি করে আসছেন তা কোনোভাবেই অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই। কেননা, আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কেননা, তারা শুধু জ্ঞান বিতরণই করেন না, এর পাশাপাশি গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করেন। জাতির জন্য আবিষ্কার করেন নতুন কিছু, তারাই সমাজে আদর্শ, জাতিকে দিয়ে থাকেন প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা। তারাই দক্ষ জনশক্তি ও শিক্ষিত জাতি তৈরির কারিগর। ফলে বিশ্বের সব দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনন্য মর্যাদা দেয়া হয়ে থাকে।

ফলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও পৃথক বেতন কাঠামো ও মর্যাদার দাবি যৌক্তিক। ঘোষিত পে-স্কেলে তাদের আর্থিক ও মর্যাদাগত দিক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। কেননা, একজন উচ্চ ডিগ্রিধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের (পুরাতন স্কেলে) শিক্ষক ১১,০০০ টাকা স্কেল থেকে চাকুরি শুরু করে ১০-১২ বছরে প্রফেসর হয়ে বেতন ভোগ করেন মাত্র ২৯,০০০ টাকা, যা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় খুবই নগণ্য।

আমরা যদি বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দিকে লক্ষ্য করি, তবে দেখতে পাই- আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক-প্রফেসর যেখানে বেতন পান (বর্তমান) ১১,০০০ থেকে ২৯,০০০ আর নতুন স্কেলে ২২,০০০ থেকে ৫৬,৫০০। সেখানে পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৭২,২০৯ থেকে ১,৬৮,৭৪৫, নেপালে ২৮,১৯২ থেকে ৬৫,১৮৪, পাকিস্তানে ৬৫,১৮৪ থেকে ২,০৩,৭০০, শ্রীলঙ্কায় ১,০৫,৬৮০ থেকে ১,৮৬,৩৪৫, ইথিওপিয়ায় ৭০,৩৯৯ থেকে ১,২৮,৭৩৮, চীনে ৯৬,৩০৯ থেকে ১,৫০,৩৩১, কাজাখিস্তানে ৮৪,৪৯৫ থেকে ১,৮৭,৭৩০, মালায়েশিয়ায় ২,৫৩,১৫৮ থেকে ৩,৬০,৩০৫, ব্রাজিলে ১,৫১,৩৯০ থেকে ৩,৭০,৭৩৪, জাপানে ২,৪২,৭২৯ থেকে ৪,৫১,৮৮৮, নাইজেরিয়ায় ২,২৪,৭২২ থেকে ৫,০৭,৫৩৯, যুক্তরাষ্ট্রে ৩,৭৩,৯১২ থেকে ৬,০১,৭৩০, কানাডা ৪,২৪,১৮৫ থেকে ৬,৫১,১৮৮, যুক্তরাজ্যে ৩,৩২,১৯৪ থেকে ৬,৮১,৯০৬ টাকা বেতন ভোগ করেন। ফলে বলা যায়, আমাদের শিক্ষকরা নতুন স্কেলেও অন্যদের ধারেকাছেও যেতে পারে নাই। ইতোপূর্বে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও বর্তমানে তিনি রহস্যজনক কারণে নীরবতা পালন করছেন। এটা কোনভাবেই কাম্য নয়।

তবে এ কথা সত্য, যে কোন দেশের চেয়ে আমরা অনেক সম্পদের অধিকারী। আমাদের অনেক কিছুই আছে যা অনেক উন্নত রাষ্ট্রের নেই। তবে কেন আমাদের দেশে এত বেকারত্ব, সন্ত্রাস, দূর্নীতি, এর দায় কে নিবে? দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থী পাশ করে জাতির মুখ উজ্জ্বল করছে। কিন্তু এ উন্নতির বাহবায় গর্ব অনুভব না করে নীরবে কষ্টই অনুভব করছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে যদি উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় তবে বলা যায়, দেশ ও বিশ্বসমাজের উন্নতির জন্য দক্ষ ও আদর্শবান পেশাজীবী এবং নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম মানবসম্পদ তৈরির চাহিদা মেটানোই বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সেটা করতে পারছে? সহজেই বলা যায়, আজকাল সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে অসহায়ের মতো বেকার জীবনযাপন করছেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকাও আশানুরুপ নয়। উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের এই বোঝা জাতির ঘাড়ে ক্রমেই ভারী হচ্ছে। এ বিচারে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো পেশাজীবী ও নেতা তৈরি করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের ভুমিকা প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক কোনো র‌্যাংকিংয়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বাংলাদেশের কোনো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম। সর্বশেষ গত ২০০০ সালে একটি র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ওঠে। এরপর আর কোনো তালিকায় স্থান পায়নি দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এমনকি সারা বিশ্বের এক হাজার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও আর খুঁজে পাওয়া যায় না বাংলাদেশের কোনো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম। ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দলবাজি, দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা, শিক্ষার্থীদের যৌনহয়রানি, শিক্ষকদের দুই-তিন বা ততোধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষকতা, সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু করে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এর দায় কিন্তু শিক্ষকরা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

অন্যদিকে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে ‘পে-স্কেল’ এমন একটি সাদামাটা বিষয়ও বুঝার মতো জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেই। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষক পোষার কি প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অচিরেই বিলুপ্ত করে দেয়া উচিত অন্যথা এই শিক্ষকদের চাকুরিচ্যুত বিদেশ থেকে জ্ঞানী-গুণী শিক্ষক আমদানি করা যেতে পারে, যারা অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য তথা ‘পে-স্কেল’ বুঝতে পারবেন। অন্যদিকে এই বক্তব্য যদি সত্য না হয়ে থাকে, তবে সেটা তাঁর চরম মূর্খতা ও ধৃষ্টতা। এর মাধ্যমে শিক্ষক সমাজ তথা গোটা জাতিকে অপমান করা হয়েছে। এ জন্য তাকে প্রকাশ্যে শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত।

তাই কার জ্ঞান বেশি তা নিয়ে অযথা বিতর্ক না করে সময় এসেছে সার্বিক বিষয় বিবেচনায় আনার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেমন কাঙ্খিত বেতন ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি অবাধ স্বাধীনতায় শিক্ষকরা যথেচ্ছা কিছু করছেন। সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বমানের বিবেচনায় কাঙ্খিত মানে উন্নীত হচ্ছে না। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো ও মর্যাদার জন্য দীর্ঘদিন থেকে যে আন্দোলন করে আসছেন তা পুনর্বিবেচনার পাশাপাশি তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক। অন্যথা, দক্ষ-মেধাবীরা এ পেশায় আসবে না। আর যেসব মেধাবীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন তারাও দেশে ফিরে জাতি গঠনে আত্মগঠনে উৎসাহী হবেন না। ফলে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো, মান মর্যাদার বিষয়ে এবং অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে বর্তমানে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনে অবিলম্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আশা করি প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে আন্তরিক হবেন।

লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক।
ই-মেইল:[email protected]



মন্তব্য চালু নেই