জামায়াতের আশা ছিল বিএনপিকে পাশে পাবে

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতার মতো কামারুজ্জামানও ধারণা করেছিলেন, দুই বছরের মধ্যে সবাই মুক্তি পাবেন। প্রথম দিকে তাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁদের মুক্তির আন্দোলনে বিএনপি পাশে থাকবে। পরে তাঁদের ভুল ভাঙে।

২০১০ সালের ১৪ জুলাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিভিন্ন সময় পরিবারের লোকদের সঙ্গে সাক্ষাতে কথাগুলো বলেছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান।

কামারুজ্জামান মনে করতেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের মুক্ত করে আনার মতো শক্তি জামায়াতের মতো ছোট দলের নেই। জামায়াত আশা করছিল, শুরুতে দলের শীর্ষ নেতা (মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী) গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিএনপি যদি তাদের (জামায়াত) সঙ্গে যোগ দিত, তাহলে দুই বছরের মধ্যে আন্দোলনের একটা ভালো ফল পাওয়া যেত। কিন্তু দেখা গেল, আন্দোলনে বিএনপি সেভাবে আসছে না। জামায়াত ছোট দল বলে মাঠ সেভাবে গরম করতে পারেনি।

কামারুজ্জামানের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে হাসান ইকবাল বড়। দুজন সুইডেনে থাকেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় থাকেন ইকবাল। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর মামার সঙ্গে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।

দীর্ঘ আলাপচারিতায় হাসান ইকবাল বলেন, তাঁর বাবার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়, তিনি (কামারুজ্জামান) মনে করতেন এসব ঘটনার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তাই আইনি লড়াই করে তিনি মুক্তি পাবেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের ভূমিকা নিয়ে পরিবারের সঙ্গে এভাবেই নিজের কথা বলতেন।

বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই-এমন ধারণা বহু আগেই কামারুজ্জামানের মধ্যে এসেছিল বলে জানান তাঁর বড় ছেলে। এ জন্য পরিবারের লোকজনকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। সম্পত্তি উত্তরাধিকারদের মধ্যে ভাগাভাগিও করে দিয়েছেন। হাসান ইকবাল বলেন, ‘আব্বা তো গ্রেপ্তারের আশঙ্কা অনেক আগে থেকে করছিলেন। সেই আশঙ্কা থেকেই আমাদের জন্য অসিয়তনামা লিখে রেখে গেছেন। এর মধ্যে সহায়-সম্পত্তির ব্যাপার-স্যাপার ছিল, এরপর আমাদের কী করা উচিত, এসব ব্যাপারে উপদেশ রেখে গিয়েছিলেন।’

পরিবারের সদস্যরা তাঁকে আত্মগোপনে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল জানিয়ে হাসান ইকবাল বলেন, ‘জামায়াতের বড় তিন নেতা (নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদী) একসঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমরা তাঁকে আত্মগোপনে থাকার জন্য বলেছিলাম। তিনি আমাদের কথাও শোনেননি। জামায়াতের অনেক নেতা কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে দল চালাচ্ছেন।’

পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জামায়াতে ইসলামীতে পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছিলেন কামারুজ্জামান। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার প্রস্তাব দেন। এ-সম্পর্কিত একটি চিঠি ২০১০ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পরই পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে দলের শীর্ষ ১৭ নেতার কাছে তিনি পাঠান।

হাসান ইকবাল বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে তিনি দলে গঠনমূলক পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছিলেন। এ বিষয়ে একাধিক লেখাও লিখেছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর জেলখানা থেকে পরিবারের মাধ্যমে একটি চিঠি জামায়াত নেতাদের কাছে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১৭ জন জামায়াত নেতার কাছে আমরা লেখাটি পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে লেখাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আমরা জানি না, এটা কে দিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমি কাউকে ব্লেম দিতে চাই না।’

হাসান ইকবাল বলেন, কামারুজ্জামানের প্রস্তাবগুলো নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর একটি অংশ বিরোধিতা করেছিল। লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর জামায়াতের সবাই দেখতে পান যে, তিনি (কামারুজ্জামান) সংগঠনে কী ধরনের পরিবর্তনের কথা ভেবেছিলেন। বিভিন্ন মহলে এটি প্রশংসিত হয়। কিন্তু যাঁরা আগের ধারায় রাজনীতি করতেন, তাঁরা এর বিরোধিতা করেন। যাঁরা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও বিশ্ব পরিস্থিতির রাজনীতি জানেন, বোঝেন—তাঁরা এটি পছন্দ করেন।’

কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর মধ্য থেকে নতুন ধারার দল গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন জানিয়ে হাসান ইকবাল বলেন, ‘দল যদি করতে হয় সেটি জামায়াতের থেকে করতে হবে—এমন একটি ইন্ডিকেশন দিয়েছিলেন আব্বা।’

রাজনীতিতে আসার ব্যাপারে কামারুজ্জামানের বড় ছেলে বলেন, ‘আমাদের আলাদা কোনো দল করার ইচ্ছে নেই। আমরা এমন কোনো চিন্তা করিনি। অল্টারনেটিভ (বিকল্প) চিন্তা যদি জামায়াত নেতাদের আসে, আমরা সেটাকে সমর্থন দেব।’



মন্তব্য চালু নেই