জামায়াতকে নিয়ে ‘ছাড়া-রাখা’র দোটানায় বিএনপি

জামায়াতকে নিয়ে দোটানায় বিএনপি। না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলতে। ফলে জোটের রাজনীতিতে বিএনপির গলার কাঁটা এখন জামায়াত। পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস ছাড়াও দেশি-বিদেশি প্রচণ্ড চাপের মুখে বিএনপি দলটিকে না পারছে ছাড়তে, না পারছে ধরে রাখতে। এমন সংকটময় অবস্থায় জামায়াতকে নিয়ে নতুন কৌশল খুঁজছেন বিএনপি হাইকমান্ড। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপি। বিএনপির নীতিনির্ধারক মহল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির এমন কোনো স্থায়ী বন্দোবস্ত নেই যে, সারাজীবন তাদের সঙ্গে রাখতে হবে, কিংবা থাকতে হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সব সময়ই তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আর সারাবিশ্বের সেন্টিমেন্ট এখন জামায়াতের বিরুদ্ধে। তারা চায় বিএনপি জামায়াত থেকে দূরে সরে আসুক, কারণ তারা মনে করে, জামায়াত আপাদমস্তক একটি সহিংস দল।

সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ৯টি দেশ ও একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কূটনীতিকদের একটি বৈঠকে জামায়াতের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের কথা সরাসরি জানতে চাওয়া হয়েছে বিএনপির কাছে। অস্ট্রেলিয়ার এবং যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার বিষয়টি আরও পরিষ্কার করেন সেই বৈঠকে। এ সময় মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের বাড়িতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে দলের আরেকজন প্রভাবশালী নেতাও অংশ নেন। বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের পক্ষ থেকে এবার কোনো রাখঢাক না করেই জামায়াতের সংগ ছাড়ার কথা বলা হয়েছে বিএনপিকে।

এমনকি বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের পক্ষ থেকেও আলাদাভাবে একই তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকালে তাকে জামায়াত সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করা হবে বলে জানান বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক। একই সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎকালে জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন বলে জানান চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা। বাংলাদেশ সফরকালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকটি করতে পারেন বলেও বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়। তবে তার কারণ সম্পর্কে সূত্রটি কিছু বলতে পারেনি।

দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য জানান, কূটনীতিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেই তো পারে। তখন আমাদেরও আর এদের নিয়ে রাজনীতি করার কোনো ঝামেলা থাকে না। তারপরও বিএনপি বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে। এ নিয়ে চিন্তাভাবনাও চলছে। এ ছাড়া জামায়াতকে সরাসরি একটি ‘জঙ্গিবাদ সংগঠন’ আখ্যা দিয়ে কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক বা না হোক বিএনপি দলটিকে ছাড়বে কি-না সেটি জানতে চান তারা। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্প্রতি জোটের একটি শরিক দলের দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালেও এমন একটি আভাসই দিয়েছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আগামী দিনের আন্দোলন হবে একেবারে শান্তিপূর্ণ। এতে তৃতীয় পক্ষের কাউকে আর কোনো রকমের সন্ত্রাস বা নাশকতা করতে দেওয়া হবে না। এ প্রসঙ্গে ওই নেতা আরও জানান, উভয় পক্ষের ভিতরেই এমন কিছু অংশ আছে যারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে এ ধরনের অশান্তির সৃষ্টি করে। এরা সব সময়ই কুপরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে (সরকার ও বিরোধী) উভয় পক্ষের মাঝে একটি ঝগড়া-ফ্যাসাদ লাগিয়ে রেখে নিজেরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকে। তবে আগামীতে আর সে সুযোগ তাদের দেওয়া হবে না। এ সম্পর্কে তিনি ২০-দলীয় জোটের শরিক জামায়াত ছাড়াও সরকারি জোটের বাম দলগুলোর একটি অংশের প্রতিও ইঙ্গিত দেন বলে জাতীয় পার্টির (জাফর) একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান।

এদিকে জামায়াতের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বিএনপির প্রতি ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, এই দল দিয়ে আর কিছু হবে না। যে দলের প্রধান নেত্রী তার দলের নীতিনির্ধারকদের বাদ দিয়ে অফিসের কর্মচারীদের কথায় দলীয় সিদ্ধান্ত নেন, সে দলের ভবিষ্যৎ কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। ‘বিএনপি জামায়াত ছাড়তে পারে কি-না’- এ প্রশ্নে- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই জামায়াত নেতা জানান, কে কাকে ছাড়ে না ছাড়ে তা আগামী কিছু দিনের মধ্যেই দেখতে পাবেন।

বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন- বিএনপি চেয়ারপারসনের এমন একজন উপদেষ্টা জানান, জামায়াতকে নিয়ে আর বোধ হয় পারা যাচ্ছে না। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দেশের পক্ষ থেকেই এবার পরিষ্কার ভাষায় আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। তারা ধর্মভিত্তিক এই রাজনৈতিক দলটিকে এবার পরিষ্কার ভাষায় ‘সন্ত্রাসী ও জঙ্গি’ সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যা এর আগে কখনো করেনি। এমনকি ঢাকার বিদেশি কূটনৈতিক কোরের পক্ষ থেকেও ঘুরেফিরে বারবার একই কথা বলা হচ্ছে এ দলটির ব্যাপারে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান আরও জানান, আন্তর্জাতিক বিশ্বে জামায়াতের ভাবমূর্তি মোটেই ভালো নয়, তা ছাড়া তাদের নীতি-আদর্শ আর আমাদের নীতি-আদর্শ সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি বিশেষ দাবিতে আমরা একসঙ্গে আন্দোলন করেছি বটে, কিন্তু তাদের গঠনতন্ত্র, আমাদের দলের গঠনতন্ত্র এবং উভয় দলের কর্মকৌশলের মধ্যে কোনো মিল নেই।



মন্তব্য চালু নেই