জাভির অশ্রুসিক্ত বিদায়

শেষ’—শব্দটার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে হাহাকার, বেদনাময় এক অনুভূতি। জীবনের সব শেষের সঙ্গেই আবেগের ঘনিষ্ঠ যোগ। গত রাতে জাভি হার্নান্দেজের ‘শেষ’টাও নিশ্চয় কাঁদিয়েছে বহু ফুটবলপ্রেমীকে। দেপোর্তিভো লা করুনার বিপক্ষে স্প্যানিশ লিগে শেষ ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন জাভি। বার্সার দীর্ঘদিনের সেনানীর বিদায়ে আবেগাপ্লুত গোটা ন্যু ক্যাম্পে। আবেগে ভাসলেন জাভি নিজেও। চোখের জলে বিদায় জানালেন প্রিয় দল, প্রিয় মাঠ, অযুত-নিযুত ভক্ত-সমর্থককে।

গোটা ন্যু ক্যাম্প ছিল জাভিময়। ঢাউস এক ব্যানারে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা, ‘#৬ধন্যবাদজাভি, ১৭ মৌসুম (১৯৯৮-২০১৫)’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই হ্যাশট্যাগে সম্মান জানানো হয়েছে জাভিকে। ভার্চুয়াল জগৎ থেকে মাঠ—সবখানেই জাভিকে দেওয়া হলো যথার্থ সম্মাননা।

ম্যাচ শেষে বার্সা খেলোয়াড়দের গায়ে সাদা টি-শার্ট। সেই টি-শার্টের পেছনে লেখা জাভির জার্সি নাম্বার—‘৬’, সামনে ‘#৬ধন্যবাদজাভি’। সতীর্থরা জাভিকে নিয়ে শূন্য ছুড়ে মাতলেন আনন্দে। স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি অ্যাঙ্গেল মারিয়া ভিয়ার কাছ থেকে লিগ শিরোপা নেওয়ার দায়িত্বও বর্তাল জাভির ওপর। উড়ন্ত লাল-বেগুনি কনফেত্তির মাঝে খনিকের জন্য হারিয়ে গেলেন বার্সার ‘ডিএনএ’! এর চেয়ে মধুর সমাপ্তি আর কী হতে পারে!

মাঠে এসেছিলেন বাবা-মা, স্ত্রী, কাছের বন্ধুরা। স্ত্রী নুরিয়া কুনিয়েরাকে নিয়ে মাঠে হাঁটলেন খানিকক্ষণ। হাত নাড়িয়ে জবাব দিলেন দর্শকদের ভালোবাসার। ভক্ত-সমর্থকদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় শেষমেশ ধরে রাখতে পারলেন না। চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুর ধারা। জাভি বললেন, ‘না কেঁদে থাকা যায় না। আবেগকে নিয়ন্ত্রণের জোর চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। এটা সম্ভব নয়। বার্সার সব কিছুই মিস করব।’ প্রায় ২৫ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার যাতনা কি এত সহজেই লুকোনো যায়?

সেই ১১ বছর বয়সে পা রেখেছিলেন বার্সায়। একজন কাতালান হিসেবে ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বার্সায় খেলবেন। বার্সার সব তারকা ফুটবলারের পোস্টার ছিল তাঁর সংগ্রহে। পেপ গার্দিওলা ছিল সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড়। লা মাসিয়ায় ভর্তি হওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু কখনোই ট্রায়ালে যাননি এই ভয়ে, ওখানে খেলার মতো যোগ্যতা হয়তো তাঁর নেই। পরে বার্সাই তাঁকে আবিষ্কার করে। ঝটপট ভর্তি হয়ে যান কাতালান ক্লাবের যুব প্রকল্পে। বাবা জোয়াকিমের হাত ধরে সেই যে লা মাসিয়াতে পা রাখা, এরপর নিজের ফুটবলপ্রতিভা আর বার্সার নিবিড় পরিচর্যা, দুইয়ের অটুট মেলবন্ধনে বেগুনি-লাল জার্সিতে পেরিয়েছে দুই যুগের বেশি সময়। সেই দীর্ঘ যাত্রার শেষ প্রান্তে আজ।

দীর্ঘ পথচলায় অর্জন নেহাত কম নয়। বার্সার জার্সিতে খেলেছেন ৭৬৫ ম্যাচ। ১৭ মৌসুম লিগ খেলে জিতেছেন আটটি শিরোপা। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন তিনটি। পেপ গার্দিওলার স্বর্ণালি সময়ে জাভি ছিলেন বার্সার মধ্যমাঠের মূল ভরসা। কেবল ক্লাব সাফল্যেই সীমাবদ্ধ নন। স্পেনের জার্সিতেও দারুণ সফল। ২০০৮ ইউরো, ২০১০ বিশ্বকাপ, ২০১২ ইউরো, ‘লা রোজা’দের শিরোপাত্রয়ী বিজয়ের অন্যতম কারিগর জাভি। স্পেনের স্বর্ণযুগে অন্যতম সাক্ষীও তিনি।

আগামী মৌসুমে খেলবেন কাতারের আল সাদে। বার্সার জার্সিতে গোধূলি বেলায় জাভিকে ছুঁয়ে যাচ্ছে গভীর আবেগ, ‘বার্সা যতটা আমাকে, তার চেয়ে বেশি বার্সাকে মিস করব। এই জার্সিতে ২৫ বছর পার করেছি। জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে এখানে। ব্যক্তি মানুষের ঊর্ধ্বে ক্লাব (বার্সা)। যারা আমাকে কখনোই হতাশ করেনি, যাদের কারণে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি এখানে, তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।’

ঠাণ্ডা মাথায় গোছানো খেলা, দ্রুত মোড় নেওয়ার ক্ষমতা, উদ্ভাবনী শক্তি আর নিখুঁত পাসিং দক্ষতায় জাভির বিকল্প কোথায়? বার্সা কোচ লুইস এনরিকে তাই বললেন, ‘জাভির কোনো বিকল্প নেই। এমন অসাধারণ খেলোয়াড়েরা বিকল্প আপনি খুঁজে পাবেন না। জাভি দুর্দান্ত এক ফুটবল প্রতিভা। ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার।’

বিদায় ভাষণে জাভি ধন্যবাদ জানালেন দীর্ঘদিনের সহযাত্রীদের, ‘আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। এখানে গত ১৭ মৌসুম কাটিয়েছি। উপস্থিত আমার পরিবার, স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব ও সবাইকে ধন্যবাদ। আমাকে নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছেন, আপনারা সত্যিই অন্যরকম।’
লিগ শিরোপা হাতে উঠেছে এরই মধ্যে। বিদায়ের বাকি আছে আরও একটু। ৩০ মে অ্যাটলেটিকো বিলবাওয়ের বিপক্ষে ন্যু ক্যাম্পে কোপা ডেল রের ফাইনাল, ৬ জুন বার্লিনে জুভেন্টাসের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল। দুটো শিরোপা জিতেই শেষটা আরও রঙিন করতে চান জাভি, ‘কোচ বলেছেন এটাই শেষ নয়। আমরা আরও দুটো শিরোপা জিততে চাই। ৭ জুন বার্সেলোনায় আপনাদের সঙ্গে শিরোপা উদ্‌যাপন করতে চাই।’ মার্কা, মেইল অনলাইন ও রয়টার্স।



মন্তব্য চালু নেই