জানেন কি? নষ্ট কম্পিউটার কোথায় যায়?

হিটলার এ হালিম: একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপের আয়ু (লাইফ সাইকেল) গড়ে ৩ থেকে ৫ বছর। এই সময় পরে সেই কম্পিউটার বা ল্যাপটপের স্থানে জায়গা করে নেয় নতুন মডেল। তাহলে পুরনো বা নষ্ট কম্পিউটারগুলো যায় কোথায়? প্রশ্নটা সাধারণ কিন্তু এর জবাব নেই কারও কাছে। প্রযুক্তি পণ্যের ক্রেতা, উৎপাদক বা আমদানিকারকরা জানেন না নষ্ট বা পুরনো কম্পিউটারগুলো কোথায় যায়।

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তাই ব্যবহারকারীদের দ্বারস্থ হতে হয়। বিভিন্ন ব্যবহারকারীর টুকরো কথার সার সংক্ষেপে জানা যায়, কিছু বাতিল কম্পিউটার মালিকের হাত থেকে এ হাত সে হাত ঘুরে যায় ভাঙারির দোকানে। তবে বেশিরভাগই পড়ে থাকে ব্যবহারকারীদের বাসা-বাড়ির টেবিলে, ঘরের কোণে, স্টোর রুমে, সিঁড়ি ঘরে নয়তো বাসার ছাদে। সেখানেই রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে থাকতে থাকতে এসব থেকে নির্গত রাসায়নিক বাতাসে মেশে, পানিতে ধুয়ে যায়, বিভিন্ন ধরনের ধাতবও বাতাসের সংস্পর্শে এসে পরিবেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে, বায়ু বা পানিকে দূষিত করছে ক্রেতার অজান্তেই। আর তা থেকে মানব শরীরে বাসা বাঁধছে প্রাণঘাতী ক্যান্সার, অ্যালার্জি, চর্মরোগের মতো বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি।

দূষণের এসব তথ্য একেবারেই অজানা নয় প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ীদের। এসব নিয়ে তারাও চিন্তাগ্রস্ত। তারা বলেছেন, বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা আমাদের বলেছেন এসব প্রাণঘাতী রোগ-ব্যাধির কথা। রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট তৈরি তাই এখন সময়ের দাবি।

দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ কম্পিউটার, ল্যাপটপ ব্যবহার অযোগ্য বা নষ্ট হয় তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে কী পরিমাণ বিক্রি হয় তার আনুমানিক ধারণা দিয়েছেন প্রযুক্তি পণ্য ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, গত বছর দেশে ৬ লাখ ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছে। ডেস্কটপের সঙ্গে এর অনুপাত ৭০:৩০। সেই হিসেবে ডেস্কটপ বিক্রির পরিমাণ আড়াই লাখের কিছু বেশি। এছাড়া বিক্রি হয় প্রিন্টার, স্ক্যানার, ফটোকপিয়ার, ইউপিএস ইত্যাদি। এসবের লাইফ সাইকেল ৩-৫ বছর। ফলে প্রতি বছরই একটা বিশাল পরিমাণ কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বেসিসের সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বললেন, গত ৫ বছর ধরে আমাদের দেশে কম্পিউটারের প্রবৃদ্ধি (বিক্রি) প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেই হিসেবে ২০১৫ সালে ল্যাপটপের বিক্রি ছিল অন্তত ৩ লাখ। যদিও সে সময় ডেস্কটপ কম্পিউটার বিক্রির হারও বেশি ছিল।

এসব পরিসংখ্যান এবং কম্পিউটারের লাইফ সাইকেল পর্যালোচনা করে বর্তমানে দেশের মোট নষ্ট কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশের সংখ্যা কল্পনা করা যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আমরা আজই (বৃহস্পতিবার) ‘ই-ওয়াস্ট ম্যানেজমেন্ট ও রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট’ তৈরির বিষয়ে একটি সভা করেছি। আমরা একটা প্রস্তাবনাও তৈরি করেছি।

আগামী সোমবার আমরা এর সঙ্গে জড়িত সব পক্ষের (স্টেক হোল্ডার) সঙ্গে বসে তা চূড়ান্ত করব। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে আমরা জাপান, চীন, কোরিয়াকে অনুসরণ করব এবং বেস্ট প্র্যাকটিসগুলো করব।

দেশে নষ্ট কম্পিউটার ও এর যন্ত্রাংশ রিসাইকেল করার জন্য কোনও প্ল্যান্ট নেই। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, এ ব্যাপারে সরকার, প্রযুক্তি পণ্যের উৎপাদক, আমদানিকারক তথা ব্যবসায়ীদের কোনও উদ্যোগ নেই। তবে সম্প্রতি প্রযুক্তি পণ্যের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিসিএস জানিয়েছে, দেশে নির্মিতব্য হাইটেক পার্কগুলোতে কম্পিউটার রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট তৈরির বিষয়ে সরকারকে তথা সরকারের আইসিটি বিভাগকে একটি পরামর্শ পত্র পাঠাবে বলে সংগঠনটির পরিকল্পনায় রয়েছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেলেন, ক্রেতা, বিক্রেতা, উৎপাদক, সরকার –কেউ জানে না পুরনো, নষ্ট কম্পিউটার কোথায় যাচ্ছে। পুরনো, নষ্ট ও ব্যবহার অযোগ্য কম্পিউটার পণ্য পরিবেশসম্মত উপায়ে ধ্বংস করে ফেলা বা পুণচক্রায়নের কোনও নীতিমালা বা দিক নির্দেশনাও নেই। তিনি আরও বলেন, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনেরও (উত্তর ও দক্ষিণ) কোনও উদ্যোগ নেই। আমরা তাই দিনে দিনে একটি ভয়ংকর অবস্থার দিকে যাচ্ছি।

বেসিস সভাপতি অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ দিয়ে বলেন, অস্ট্রেলিয়াতে একেবারে পুরনো ও নষ্ট কম্পিউটার রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এ বিষয়ে সে দেশের সরকারের অবস্থান বেশ কঠোর। কাজটি করার জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থাও রয়েছে। আরও অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব কম্পিউটার পণ্যের মধ্যে যেসব রাসায়নিক ও ধাতব পদার্থ রয়েছে তা কখনও নষ্ট হয় না। ফলে তা পরিবেশে মিশে আমাদের ক্ষতি করছে।

কম্পিউটার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডেল বাংলাদেশর কান্ট্রি ম্যানেজার আতিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে ডেলের কোনও রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট নেই। তারা কেবল এ দেশে কম্পিউটার বিপণন এবং বিক্রিই করে থাকেন। আগামীতে করা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত এ ধরনের কোনও পরিকল্পনা ডেলের নেই। ভবিষ্যতে হবে কিনা সে বিষয়ে তিনি কোনও তথ্য দিতে পারেননি। দেশে কি পরিমাণ ডেল পণ্য (ডেস্কটপ কম্পিউটার, ল্যাপটপ) নষ্ট হয়, ব্যবহার অযোগ্য হয়ে যায়, গ্রাহক কোথায় তা ফেলে দেয় সে বিষয়েও ডেল বাংলাদেশের প্রধান অন্ধকারে বলে জানা গেল।

এইচপি বাংলাদেশের প্রধান ইমরুল হোসেন ভূঁইয়া জানলেন, দেশে এইচপির কোনও রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট নেই। তারা আসলে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান।আগামীতে এ ধরনের কোনও কিছু করা হবে কিনা সে পরিকল্পনার কথা তিনিও বলতে পারেননি।

তবে তিনি বলেন, যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে রিসাইক্লিং করতে চান তাহলে তিনি লাভবান হবেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ রিসাইক্লিং করলে এর ভেতরে স্বর্ণ পাওয়া যায়। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো এগুলো তৈরিতে স্বর্ণ ব্যবহার করে থাকে। এর পেছনে উদ্দেশ্য হলো কম্পিউটারের ফাইন টিউনিং এবং রিসাইক্লিং এর প্রতি আগ্রহী করে তোলা। একটি ল্যাপটপ বা অন্য কিছু রিসাইক্লিং করে যে পরিমাণ স্বর্ণ পাওয়া যায় তা এ কাজের সঙ্গে জড়িতদের লাভই হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এভাবেই কাজ হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) সভাপতি আলী আশফাক বলেন, আমরা বিসিএস থেকে এটা করতে চাই। এ ব্যাপারে সরকার সহযোগিতা করলে আমাদের উদ্যোগ নেওয়াটা সহজ হয়ে যায়। তিনি বলেন, দেশে একাধিক হাইটেক পার্ক হচ্ছে। সেসব পার্কে যদি একটা করে রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট করে দেওয়া যায় তাহলে সেসব জায়গায় বৈজ্ঞানিক উপায়ে এসব করা সম্ভব। প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে রিসাইক্লিং করতে পারবে। আমরা সংগঠন থেকে তাতে সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করব। ব্যবসায়িকভাবে অংশ নিতেও পারবো। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। তিনি মনে করেন, এসব উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি এ বিষয়ক একটি নীতিমালা ও নির্দেশনা থাকতে হবে।

আলী আশফাক আরও বলেন, এরই মধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমরা আমাদের ভাবনাগুলো (হাইটেক পার্কে রিসাইক্লিং করার প্ল্যান্ট) পরামর্শ আকারে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কাছে পেশ করব।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলিফ্যান্ট রোডের কয়েকজন ব্যবসায়ী পুরনো, নষ্ট কম্পিউটার সংগ্রহ করে ভালো যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে তা নষ্ট করে ফেলেন। নষ্ট করে কোথায় ফেলেন, পরিবেশসম্মত উপায়ে করেন কিনা, কোনও ধরনের অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে কেউই নিজেকে উদ্ধৃত করে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তারা জানান, যা করছেন সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে। এই কাজে কোনও ধরনের প্রণোদনা পান না কারও কাছ থেকে। পেলে আরও ভালোভাবে কাজটি করতে পারতেন বলে জানান। তারা এ-ও জানালেন, মাঝে মাঝে তারা কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহজে একেবারে পুরনো এবং নষ্ট কম্পিউটার সংগ্রহ করতে পারেন।

বাংলাদেশে আসুস পণ্যের পরিবেশক (আমদানিকারক) গ্লোবাল ব্র্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল ফাত্তাহ জানান, বাংলাদেশে আসুসের ওরকম কিছু নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেও চান দেশে অবশ্যই রিসাইক্লিং এর ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিনি বলেন, তা নাহলে একদিন কোথায় যে যাবো তা ভাবতেও পারি না।

আবদুল ফাত্তাহ জানান, তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজন বিনিয়োগকারীকে রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট গড়ে তোলার জন্য এনেছিলেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদফতরে গিয়ে তাদের যে অভিজ্ঞতা হয় তাতে তাদের মনে হয়েছে, সরকার নিজে উদ্যোগ না নিলে এ বিষয় কেউ-ই অগ্রসর হতে পারবে না। -বাংলা ট্রিবিউন।



মন্তব্য চালু নেই